পুরুন্ডি, ঢাডডা, চেপ্টি বা মালসা তাদের রোজের মধ্যাহ্নভোজ। সঙ্গে চালতা, বনকাঁঠাল, কচি বাঁশ, কলা, অর্জুনের ছাল, শিশুর কচি পাতা। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ সবও তাদের চেনা প্রাতরাশ বা বিকেলের টুকিটাকি।
তবে, চাইলেই কি আর পাওয়া যায়! উত্তরের বনে-বাদাড়ে যা দক্ষিণের রাঢ় জঙ্গলে তার অনেক কিছুই মেলে না। জঙ্গলের গায়ে গায়ে গড়ে ওঠা আবাদি জমিতে নতুন স্বাদের ধান-সব্জির খোঁজ পেলে কে আর লোভ সামলাতে পারে? দক্ষিণবঙ্গের হস্তি-উপদ্রুত তিন জেলা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে এই বাড়তি পাওনাটুকু তাই চেটেপুটে উপভোগ করে মরশুমি হাতির দল।
ঝাড়খণ্ডের দলমা পাহাড় আর বাল্মিকী কিংবা সারান্ডার বন থেকে পায়ে-পায়ে নেমে আসা হস্তিুযূথ প্রতি মরশুমেই আসে ওই তিন জেলার শাল-সেগুনের জঙ্গলে। বর্ষার শেষ দিকে ধানের কচি শিশে ‘দুধ’ জমে উঠতেই চেনা খাদ্য তালিকার বাইরে ধান-সব্জির টানে তাদের আগমন। ধান ফুরোলে তখন প্রাক-শীতের মরশুমি আনাজের দিন। তিন জেলা ঢুঁড়ে জমি দাপিয়ে তা-ও উপভোগ করে তারা। তার পরে ফেরার পালা।
তবে সবাই কি আর ফেরে? গত সাত-আট বছরে দলমার দামালদের অনেকেই ঠাঁইনাড়া হয়ে পাকাপাকি ভাবে রয়েছে গিয়েছে তিন জেলার কোনও না কোনও জঙ্গলে। তাদের গায়ে এখন তকমা পড়েছে ‘রেসিডেন্ট এলিফ্যান্ট’। গত দশ বছরে তিন জেলার জঙ্গলে হাতির সংখ্যা এই ভাবেই ২০ থেকে বেড়ে অন্তত ৬০। তবে বন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জানিয়েছেন, থেকে যাওয়ার কারণ নিছকই ধান-সব্জির টান নয়। দলছুট হয়ে, দলপতির সঙ্গে বিরোধের জেরে, এলাকা দখলের লড়াইয়ে হেরে গিয়ে কিংবা দল ফিরে যাওয়ার সময়ে সন্তানসম্ভবা হাতি পিছিয়ে পড়ায় অনেক ক্ষেত্রে রেসিডেন্ট হয়েছে। |
তবে তিন জেলায় এ ভাবে হাতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই বাঁকুড়া, পুরুলিয়া কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরে হাতি-মানুষ সংঘাত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। এত দিন যারা ছিল নিছকই ‘মরশুমি সমস্যা’ তারা এখন রেসিডেন্ট হয়ে সম্বৎসরের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপরে দলমার দামালরা নিয়ম করে নেমে এলে সমস্যাটা প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। আবাদ করাটাও তাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজ্যের মুখ্য বনপাল (সেন্ট্রাল) বিনোদকুমার যাদবও বলছেন, “সমস্যাটা পাকছে। হাতি মোকাবিলায় একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জরুরি। শুধু বন দফতর নয়, প্রশাসনের সমস্ত দফতরকেই দল বেঁধে সেই পরিকল্পনা করতে হবে। কারণ, দলমার হাতির দল এখন শুধু এ রাজ্যে বেশি সময় থাকছেই না, ক্রমশ তারা এলাকাও বাড়িয়ে চলেছে।”
হাতির এলাকা সম্প্রসারণের বিষয়টিও নতুন নয়। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রতি গ্রীষ্মে হাতিদের ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’-এর সময়ে দেখা গিয়েছে প্রতি বছর তারা খাবারের সন্ধানে এলাকা বাড়ায়। দলমার দামালদের ক্ষেত্রেও গল্পটা একই। আশির দশক থেকে এ বঙ্গে আনাগোনা শুরুর পরে তারা ক্রমেই আনাগোনার এলাকা বাড়িয়ে গিয়েছে। হস্তি বিশেষজ্ঞ ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর মতে, হস্তি অভিধানে এটাই ‘নিয়ম’।
জঙ্গলে পর্যাপ্ত খাবারের পাশাপাশি লাগোয়া জমিতে খাবারের প্রাচুর্য, হাতিদের দক্ষিণবঙ্গের তিন জেলার প্রতি ‘মমতা’ বাড়িয়ে দিয়েছে। বন দফতরের খড়্গপুরের ডিএফও অঞ্জন গুহ বলেন, “কী ভাবে সহজে খাবার সংগ্রহ করা যায়, পশুরা তার চেষ্টায় থাকে। সহজে খাবার পেতেই সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে বাঘ লোকালয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। আবার সেই লক্ষ্যেই হাতিও দলমা থেকে এখানে এসে থেকে যাচ্ছে।” রূপনারায়ণ বিভাগের ডিএফও রবীন্দ্রনাথ সাহা বলেন, “আমাদের জেলার জঙ্গলের চিত্রটা এমন যে, কিছুটা টানা জঙ্গল, ফের ফসলের খেত, আবার জঙ্গল। ফলে হাতি সহজেই ফসল খেয়ে ফের জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে পারে। এক দিকে হাত বাড়ালেই খাবার, অন্য দিকে খেয়েই ফের জঙ্গলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়।”
রেসিডেন্ট হাতির সংখ্যা বাড়ায় শস্যহানির ঘটনাও বেড়ে গিয়েছে। ঘরবাড়ি ভাঙা, প্রাণহানির ঘটনাও বেড়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় গত তিন বছরে হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে ৫৬ জনের। আহত হয়েছেন ৮৯ জন, শস্যহানি হয়েছে ৭১৩১ হেক্টর জমির, ৪৭০০ বাড়ি ভেঙেছে। বন দফতরকে ৫ বছরে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা। ক্রমবর্ধমান ক্ষতি রুখতে চেষ্টাও হয়েছিল ঢের। জঙ্গলের ধারে নালা কাটা, কাঁটাগাছ লাগানো, লঙ্কা চাষ করা, কোথাও বা বিদ্যুতের তার দিয়ে গ্রাম ঘেরা। কিছুতেই সুরাহা হয়নি। কিছু দিন আগে রাজ্যের বনকর্তারা কয়েকটি দলমার দামালকে ধরে তাদের মধ্যে ‘আতঙ্ক’ ছড়ানোরও চিন্তাভাবনা করেছিলেন। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রকের প্রজেক্ট এলিফ্যান্ট কর্তৃপক্ষ সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন।
তা হলে উপায়? পরিচিত এক হস্তি বিশেষজ্ঞের কটাক্ষ, ‘দক্ষিণবঙ্গের তিন জেলায় হাতি-মানুষের এই টক-ঝাল সম্পর্কই বুঝি ভবিতব্য!’ |