উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের ডঃ মেঘনাদ সাহা কলেজে অধ্যক্ষা-নিগ্রহের ঘটনায় দু’তরফের বিরুদ্ধেই জামিন অযোগ্য-ধারায় মামলা শুরু করল পুলিশ।
মঙ্গলবার ওই কলেজের পরীক্ষার সময়ে টোকাটুকির অভিযোগে জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি তথা জেলা পরিষদ সদস্য গৌতম পালের স্ত্রীর খাতা কেড়ে নেওয়া হয়। গৌতমবাবু, তাঁর স্ত্রী, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা বাবুসোনা মোহান্ত ও আরও কিছু লোক অধ্যক্ষা-সহ তিন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও এক শিক্ষাকর্মীকে মারধর করেন বলে অভিযোগ। গৌতমবাবুর পাল্টা দাবি, তল্লাশির নামে তাঁর স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল।
দু’পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে গৌতমবাবু, তাঁর স্ত্রী এবং বাবুসোনার বিরুদ্ধে কলেজে অনধিকার প্রবেশ, মারধর, শ্লীলতাহানি, চুরি ও ভয় দেখানোর মতো কয়েকটি অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। অন্য দিকে, গৌতমবাবুর স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখোপাধ্যায়, বাংলার শিক্ষক সুদেবকুমার রায়, রসায়নের শিক্ষিকা সেঁজুতি দে ও শিক্ষাকর্মী জাফর সাদেকের বিরুদ্ধে মারধর ও শ্লীলতাহানির মামলা শুরু করা হয়েছে। উভয় পক্ষের বিরুদ্ধেই জামিন-অযোগ্য ধারা রয়েছে। তবে পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করেনি। উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, “পুলিশ তদন্ত করে প্রয়োজনে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করবে।”
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু রাজ্যের শিক্ষা অধিকর্তাকে সাত দিনের মধ্যে ঘটনার রিপোর্ট দিতে বলেছেন। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফেও ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া দলীয় স্তরেও ঘটনাটির তদন্ত শুরু করছে তৃণমূল। উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তা বলেন, “কলেজের ঘটনা নিয়ে খোঁজখবর করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার চিঠি পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হবে গোলমালের দিন ঠিক কী ঘটেছিল।” ব্রাত্যবাবু বলেন, “বিধায়ক ও জেলা সভাপতি অমল আচার্যকে বলেছি দলীয় স্তরে ঘটনার খোঁজ নিয়ে কড়া পদক্ষেপ করতে।” |
অমলবাবু অবশ্য স্বপ্নাদেবীর অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলেছেন। স্বপ্নাদেবী ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করার সুযোগ করে দিয়েছেন, এমন অভিযোগও করেন তিনি। অন্য দিকে, স্বপ্নাদেবীর স্বামী তথা রাজ্যের প্রাক্তন অসামরিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “কলেজের কেউ যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে শাসক দলের কোনও নেতার স্ত্রীর শ্লীলতাহানি করে থাকেন, তবে পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেফতার করছে না কেন, বুঝতে পারছি না।”
শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মী নিগ্রহে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে এ দিন বিকেলে ইটাহারের বিভিন্ন এলাকায় ধিক্কার মিছিল হয়। শ্রীকুমারবাবুর নেতৃত্বে ওই মিছিলে বামফ্রন্টের কর্মী-সমর্থকদেরই হাঁটতে দেখা যায়। একই দাবিতে রায়গঞ্জেও মিছিল করেন এসএফআই ও ডিওয়াইএফের কয়েকশো সমর্থক। জেলা জুড়ে টানা আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন ওই দুই সংগঠনের জেলা নেতৃত্ব। কলেজের ওই গোলমালকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ও সিপিআইয়ের মধ্যে চাপান-উতোর শুরু হওয়ায় এ দিন ইটাহারের পরিবেশ ছিল থমথমে।
পুলিশ সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে ইটাহার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জখম স্বপ্নাদেবী, সেঁজুতিদেবী, সুদেববাবু ও জাফর সাহেবকে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। এ দিন স্বপ্নাদেবী ও সেঁজুতিদেবী বাড়ি চলে গেলেও সুদেববাবু ও জাফর সাহেব হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রত্যেকেরই বুকে, পেটে, পিঠে, চোখে ও হাতে-পায়ে চোট লেগেছে।
স্বপ্নাদেবী বলেন, “টুকলি আটকাতে গিয়ে এ ভাবে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের হাতে মার খেতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। উল্টে আমাদের বিরুদ্ধেই থানায় মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হল।” তিনি জানান, টুকলির কাগজ-সহ ওই ছাত্রীর পরীক্ষার খাতা গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক সনাতন দত্ত জানান, আজ, বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদল কলেজে গিয়ে ওই ঘটনার তদন্ত করবে।
এই ঘটনার নিন্দা করেছে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (ওয়েবকুটা)। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা টুকবে, কিছু বলা যাবে না? আর তারা শাসক দলের নেতা-নেত্রীর আত্মীয় হলে নকলে বাধা দেওয়ায় অধ্যক্ষ, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আক্রান্ত হতে হবে, শ্লীলতাহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে, এই জমানায় এটাই কি দস্তুর?” কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আংশিক সময়ের শিক্ষক সুগঠন ‘কুটাব’-এর সাধারণ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দেবনাথও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
|