সময়টা মঙ্গলবার দুপুর।
কলকাতায় দলের ছাত্র সংগঠনের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “এমন কিছু করবেন না, যাতে কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকারা দুঃখ বোধ করেন। এমন কিছু করবেন না, যাতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ছেলেদের মানুষ ভুল বোঝেন। বরং বাঁ হাতে লিখে রাখুন ‘বি কুল’।”
উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারে মেঘনাদ সাহা কলেজে তখনই চলছে ধুন্ধুমার। পরীক্ষায় টোকাটুকি করার অভিযোগে দলীয় নেতার স্ত্রীর খাতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তার উত্তরে ওই তৃণমূল নেতা এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা কলেজের অধ্যক্ষাকে প্লাস্টিকের চেয়ার ছুড়ে মেরেছেন বলে অভিযোগ। কলেজের আরও দুই শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং এক শিক্ষাকর্মীকেও বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। আহত ৪ জনকে প্রথমে ইটাহার ব্লক হাসপাতাল ও পরে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
|
শিক্ষিকা সেঁজুতি দে |
গোলমালের শুরু তিনটে নাগাদ। ইটাহারের কলেজে এ দিন প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষায় টুকলি করার অভিযোগ ওঠে জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি তথা জেলা পরিষদ সদস্য গৌতম পালের স্ত্রী-র বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখোপাধ্যায় তাঁর খাতা কেড়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যান। গৌতমবাবু এবং তাঁর ছ’সাত জন অনুগামী তখন ইউনিয়ন রুমে বসেছিলেন। খবর পেয়েই তাঁরা দৌড়ে পরীক্ষার হল-এ যান। সেই সময় শিক্ষক-পরিদর্শক সেঁজুতি দে এবং সুদেব রায়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি চলছিল অভিযুক্ত ছাত্রীর। কলেজ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, হলের মধ্যেই সেঁজুতিদেবী এবং সুদেববাবুকে মারধর করতে থাকেন গৌতমবাবুরা। হলের সামনে থাকা হোমগার্ডের লাঠি কেড়ে নিয়ে সুদেববাবুকে মারা হয়। মার খান শিক্ষাকর্মী জাফর সাদেকও। গোলমাল শুনে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন অধ্যক্ষা। গৌতমরা তাঁকে করিডরেই আটকে মারতে মারতে ঘরে ঢুকিয়ে দেন। চেয়ার ছুড়ে মারার পাশাপাশি তাঁর বুকে-পিঠে ঘুষি-চড় মারা হয়েছে বলে অভিযোগ।
চারটে নাগাদ পুলিশ আসে। তত ক্ষণ ব্যাপক মারধর, ভাঙচুর চলেছে। আছড়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে চেয়ার-টেবিল। শিক্ষকদের কারও চোখ ফুলে গিয়েছে। কারও চশমা ভেঙেছে।
মুখ্যমন্ত্রী যখন বারবার ছাত্র রাজনীতিতে অশান্তি বন্ধ করার কথা বলছেন, তখন ফের এমন ঘটনা ঘটল কেন? তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয়। অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” স্থানীয় তৃণমূল যদিও মারধর-ভাঙচুরের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের পাল্টা অভিযোগ, টোকাটুকি ধরার নামে ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল। তাতেই উত্তেজনা ছড়ায়।
গৌতমবাবুর বক্তব্য, “অধ্যক্ষা আমার মায়ের মতো। তিনি তল্লাশির নামে সকলের সামনে আমার স্ত্রী-র শ্লীলতাহানি করাবেন, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। আমার স্ত্রী-র সোনার হারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।” স্বপ্নাদেবী এই অভিযোগ নস্যাৎ করে বলেন, “টুকলির কাগজ কেড়ে নেওয়ায় ওই ছাত্রী চেঁচামেচি করতে থাকেন। তাই প্রথমে কড়া শাস্তি দেব না ভাবলেও পরে খাতা কেড়ে নিয়েছিলাম।” তাঁর দাবি, “এর পরেই গৌতমবাবু ও তাঁর অনুগামী বাবুসোনার নেতৃত্বে হামলা শুরু হয়। পরে আমার ঘরে ঢুকে যথেচ্ছ মারধর করেন ওঁরা।” গৌতমবাবুর কথায়, “আমরা মারধরের মধ্যে থাকি না। কেউ নিজেরা ভাঙচুর করে অন্যকে ফাঁসাতে পারেন।” |
এই ঘটনায় রাজনীতির রং-ও জড়িয়েছে। অধ্যক্ষা প্রাক্তন অসামরিক প্রতিরক্ষামন্ত্রী তথা সিপিআই নেতা শ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। গৌতমের অভিযোগ, “স্বপ্নাদেবী সিপিআই নেত্রী। আমি তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে জেলা পরিষদে জিতে যাওয়াতেই তিনি তাঁর অনুগামী শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে টুকলি ধরার অছিলায় আমার স্ত্রীকে ফাঁসাতে চেয়েছেন।” শঙ্কুদেব সরাসরি এমন কথা না বললেও এটুকু মনে করিয়ে দেন, “ওই কলেজের অধ্যক্ষের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। আশা করব, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অভিযোগ করছেন না।” সিপিআই ছাত্র সংগঠন এআইএসএফ-এর রাজ্য সম্পাদক পার্থ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “নকল করতে দিতে হবে, সাতের দশকের পরে এই দাবি ফিরিয়ে এনেছে বর্তমান শাসক দল! শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা কলেজের ভিতরেও নিরাপদ নন।”
এই দাবি-পাল্টা দাবির বাইরে অবশ্য ইটাহারের ঘটনা শিক্ষাক্ষেত্রে অশান্তির ছবিই ফেরাল বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তর দিনাজপুরেরই রায়গঞ্জ কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহ, নদিয়ার মাজদিয়া কলেজে মারামারি, কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুরের স্মৃতি ফের উস্কে দিয়েছে এই ঘটনা। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে গোলমালে কলকাতা পুলিশের ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যু হয়। তার পরই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হানাহানির কারণেই ছাত্রভোট স্থগিত করা হচ্ছে বলে তখন জানানো হয়েছিল।
সম্প্রতি ছাত্র সংসদের ভোট ফের শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য এখন বলছেন, হানাহানির জন্য নয়। পঞ্চায়েত ভোটের জন্যই ছাত্র সংসদের নির্বাচন সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিল। এ দিন কলকাতার সমাবেশে খোদ মমতাও সে কথাই বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন জানান, ভাইফোঁটার পরেই ছাত্র সংসদের ভোট শুরু হবে। তবে এ দিন শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী, দু’জনের বক্তৃতাতেই স্পষ্ট ছিল যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশান্তি নিয়ে সরকার কতটা উদ্বিগ্ন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে এ বার থেকে একই দিনে ছাত্র সংসদের ভোট হবে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “একই দিনে ভোট হলে বাইরে থেকে গুন্ডা নিয়ে গোলমাল বন্ধ হবে। শান্তিতে ভোট হবে।”
তবে ইটাহার ফের দেখিয়ে দিল যে কলেজে অশান্তি শুধু ছাত্রভোটেই সীমাবদ্ধ নেই! |