কেউ কেউ ফেরেন। সকলেই নন। রুজির টানে মাছ ধরতে ওঁরা পাড়ি দেন দূর সমুদ্রে। অনেক দিনের পথ। ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের ভুখা সংসার। দিন কেটে যায়। তার পর হয়তো খবর আসে, আর ফিরবে না বাড়ির রোজগেরে পুরুষটি। সমুদ্রে ডুবে গিয়েছে মাছ ধরার ট্রলার। কাকদ্বীপের মৎস্যজীবী পরিবারগুলির জীবনের বাস্তব সত্য এটাই।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ ব্লকের অক্ষয়নগর, সতীশনগর, আমড়াতলা, শিবনগর, কালিনগর—গ্রামগুলিতে বেশিরভাগই মৎস্যজীবী পরিবারের বসতি। বছরভর মাছ ধরাই এঁদের এক মাত্র রুজি। বর্ষায় ভরা মরসুমে আরও বেড়ে যায় কাজের চাপ। সোনালি ফসলের (ইলিশের) খোঁজে তোলপাড় হয় সমুদ্র। ভরা বর্ষায় বৃষ্টি আর দুর্যোগ মাথায় নিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার পথে অনেক ট্রলারই ডুবে যায় সমুদ্রে। দিনের পর দিন রোদে পোড়া, জলে ভেজা শরীরগুলোর খোঁজ কখনও মেলে, কখনও মেলে না।
২০১১ সাল থেকে এই সব গ্রাম থেকে নিখোঁজ হয়েছেন অনেকে। ২০১১ সালের ১৫ জুন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল দু’টি ট্রলারএফ বি শ্যামাচরণ এবং এফ বি কল্যাণী। মাঝদরিয়ায় প্রবল ঝড়ে ডুবে যায় সেগুলি। ট্রলারে ছিলেন ৩১ জন। দেহ উদ্ধার হয়েছিল মাত্র দু’জনের। বাকিদের কোনও খোঁজ মেলেনি। আর সেজন্য ‘নিরুদ্দেশ’ এই মৎস্যজীবীদের পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণও পায়নি। স্বামী-সন্তান হারিয়ে নিঃস্ব পরিবারের মেয়েরা। চলতি বছরেও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছেন কালিনগর, পূর্বগঙ্গাধরপুর, পশ্চিম গঙ্গাধরপুর গ্রামের চার জন। |
বসন্তপুর গ্রামের মেজোরানি দাস বলেন, “২০১১ সালের ওই দিন আমার স্বামী সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলেন। এখন দুই ছেলে মাছ ধরতে যাচ্ছে। বিপদ আছে, জানি। ছেলেরা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিমুহূর্তে ভয়ে থাকি। কিন্তু ওরা মাছ ধরতে না গেলে খাব কী? পেট বড় দায়।” শিবপুর গ্রামের শিখা দাসও ওই ট্রলারডুবিতে স্বামীকে হারিয়েছেন। নিরুপায় হয়ে তাঁর ছেলেরাও এখন যায় গভীর সমুদ্রে, মাছ ধরতে। শিখা, মেজোরানিদের ক্ষোভ, “পরিবারের একমাত্র রোজগেরে লোকটা চলে গেল। অথচ কেউ কোনও খোঁজ নিল না। পেলাম না কোনও ক্ষতিপূরণও।”
মৎস্যজীবীদের দাবি, বর্ষার মরসুমে ইলিশ ধরার জন্য বহুদূরে যায় ট্রলারগুলি। মৎস্যজীবী কমল দাস, সনাতন দাস, প্রবীর জানা বলেন, “আমরা প্রতি মরসুমে বার পাঁচেক গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাই। প্রতি বার আট থেকে দশ দিন থাকতে হয়। মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক সময়ে মাঝসমুদ্রে অসুস্থ হয়েও অনেকে মারা যান।” মৎস্যজীবীরা আরও জানান, বড় দুর্ঘটনা না ঘটলে প্রতি বছর সমুদ্রে গিয়ে অন্তত চার পাঁচ জন তো মারা যানই। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত সমুদ্রে গিয়ে চার-পাঁচ জন ফেরেননি।
কাকদ্বীপের অজয়নগর সুন্দরবন মৎস্যজীবী সমিতির সহ-সম্পাদক নারায়ণ দাস বলেন, “সরকার থেকে মৎস্যজীবীদের জন্য একটি জীবনবিমা থাকে। ট্রলারের মালিকও জীবনবিমা করে রাখেন। ট্রলার দুর্ঘটনার পর দেহ উদ্ধার হলে, দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা। কিন্তু দেহ উদ্ধার না হলে নিখোঁজ থাকার ৭ বছর পরই ক্ষতিপূরণ পেতে পারে নিখোঁজের পরিবার।”
এত ঝুঁকি নিয়ে রোজগার। কত টাকা পান মৎস্যজীবীরা? কমল দাসরা জানান, মরসুমের আগে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে দেয় মালিক। মাছ নিয়ে ফেরত আসার পরে মালিকই ঠিক করে দেয় লাভের অঙ্ক। যা লাভ হয়, তার ৪০ শতাংশ পাওয়ার কথা মৎস্যজীবীদের। তবে পুরোটাই নির্ভর করে মাছ কত ওঠে তার উপর।
|