|
|
|
|
বস্তিতেই ‘হারানো’ ছেলের খোঁজ পেয়েছেন মঞ্জু |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে জীবনটাই অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। কার জন্য বাঁচবেন, কেন বাঁচবেন, জবাব হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন। পুত্রহারা সেই জননীই এখন বস্তিবাসী ছেলেমেয়েদের মঞ্জু মা। এক ছেলে হারানোর শোক ভুলে তিনি মেতে রয়েছেন অনেক ছেলেমেয়েকে নিয়ে।
মেদিনীপুর শহরের নতুন বাজারের বাসিন্দা মঞ্জু মাইতি। বস্তি এলাকার ছেলেমেয়েদের পড়ানো, গান-আবৃত্তি শেখানো, জামাকাপড় কেচে দেওয়া এ সব নিয়েই এখন মঞ্জুদেবীর জগৎ। বস্তির ঘুপচি ঘর থেকে কয়েকজনকে এনে নিজের বাড়িতেই রেখেছেন। ওদের কারও বাবা দিনমজুর, কারও মা পরিচারিকার কাজ করেন। মঞ্জুদেবী বলছিলেন, “এই সব ছেলেমেয়েরাই আমার সন্তান। ওদের কিছু শেখাতে পারলে নিজের ভাল লাগে। ছ’বছর আগে নিজের ছেলেকে হারিয়েছি। এখন হারাধন-অর্জুন-তুলসীরাই আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা।” বলতে বলতে চোখে জল আসে ছেলেহারা মায়ের। |
|
কচিকাঁচাদের মাঝে মঞ্জু মাইতি। মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। —নিজস্ব চিত্র। |
মঞ্জুদেবী ও তাঁর স্বামী শৈলেন্দ্রনাথ মাইতির একমাত্র ছেলের নাম ছিল সায়ন। ২০০৭ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে। দিনটার কথা মনে করলেই চোখে জল আসে মাইতি দম্পতির। ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর। ওই দিনই সব তছনছ হয়ে যায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশনের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সায়নের। শৈলেন্দ্রনাথবাবুর কথায়, “কেমো চলছিল। ভুল চিকিৎসার মাসুল দিতে হয়েছে আমার ছেলেকে। ওই দিন সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন না। জুনিয়র ডাক্তার চিকিৎসা করছিলেন। তিনিই ভুল চিকিৎসা করে বসেন।” সায়ন ক্যানসার আক্রান্ত, সে কথা মাত্র তিন মাস আগে জানতে পেরেছিলেন মঞ্জুদেবীরা। মঞ্জুদেবী বলেন, “সায়ন সকলের খুব প্রিয় ছিল। লেখাপড়া ছাড়াও ভাল আবৃত্তি করত। এক দিন হঠাৎ স্কুল থেকে ফিরে বলল, ‘মা, আমার মাথা ঘুরছে। পা ফেলতে অসুবিধে হচ্ছে।’ আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই। পরে জানতে পারি, ওর ক্যানসার হয়েছে। চিকিৎসা শুরু হয়। তবে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারিনি।”
সায়নের মৃত্যু পর জীবন যখন শূন্য, তখনই মঞ্জুদেবী ‘সারদা শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে’র সন্ধান পেলেন। মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে বস্তি এলাকার উন্নয়নে কাজ করে এই কেন্দ্র। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের এখানে পড়ানো হয়। কেন্দ্রটি চালু হয়েছে ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি। প্রায় গোড়া থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত মঞ্জুদেবী। এখন কেন্দ্রে ৫৬ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। ওদের মধ্যে হারাধন মুর্মু, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবা নিমাই মুর্মু মজুর। মা অঞ্জলিদেবী পরিচারিকার কাজ করেন। অর্জুন সরেন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তুলসি বাস্কে পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। বাবা হুকু বাস্কে মজুর। মা পম্পাদেবী পরিচারিকার কাজ করেন। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ভরত বাস্কে বলছিল, “আমরা গরিব। দিদিমণি সব সময় আমাদের পাশে থাকেন। উৎসাহ দেন। আমরা আরও পড়তে চাই।”
সারদা শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে মোট ৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। মেদিনীপুর শহরে বেশ কয়েকটি বস্তি এলাকা রয়েছে। যে সব এলাকায় শিক্ষার আলো এখনও সে ভাবে পৌঁছয়নি। রয়েছে অসচেতনতা। মেদিনীপুর রামকৃষ্ণ মঠের অধ্যক্ষ স্বামী শ্রুতিসারানন্দ বলছিলেন, “শিক্ষার আলো দেখিয়ে ওই ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। মঞ্জুদেবীরা যাদের দেখভাল করেন, তাদের অনেকেই খুব মেধাবী। একজন স্কুলের পরীক্ষায় অঙ্কে তিরিশে তিরিশ পেয়েছে।” ‘সারদা শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের’ বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই তফসিলি জাতি উপজাতি সম্প্রদায়ের। এই সব ছাত্রছাত্রীদের জাতিগত শংসাপত্রের জন্য মহকুমাশাসক (সদর) অমিতাভ দত্তের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। সব দিক খতিয়ে দেখে আজ, বৃহস্পতিবার এদের কয়েকজনকে শংসাপত্র দেওয়া হবে। মহকুমাশাসক বলছেন, “একবার মিশনে গিয়ে ওঁর (মঞ্জুদেবী) কথা শুনেছিলাম। পরে দেখাও করি। উনি যে কাজ করছেন, তা সত্যিই শেখার মতো। আসলে আমাদের সকলেরই সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে।”
মঞ্জুদেবীর আদরযত্নে বড় হচ্ছে ভরত-তুলসীরা। এক পরিচারিকার ছেলে হারাধন মুর্মু কবিতাও লিখেছে। সম্প্রতি, এক সংস্থার স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছে সেই কবিতা। নাম ‘মধুমাখা দিন’। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র হারাধন লিখেছে,
‘রবিবার মধুমাখা দিন
মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াই কাটে আমার দিন।
..... পেটের জ্বালায় আমি বাড়ি ফিরে দেখি
খাবারের হাঁড়িটা যে ওল্টানো এ কী?’
স্বামী শ্রুতিসারানন্দের কথায়, “স্বামীজী চেয়েছিলেন, পিছিয়ে পড়া এলাকার ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আঙিনায় আসুক। তারাও মানুষের মতো মানুষ হোক। মঞ্জুদেবী সেই কাজটাই করছেন। এটা বিরাট কাজ। উনি এক সন্তানকে হারিয়েছেন। এখন ওঁর অনেক সন্তান।”
মঞ্জুদেবীও বলছেন, “আমি স্বামীজীর সেবা-আদর্শের কথা মাথায় রেখেই চলছি। বাকি জীবনটা ওদের নিয়েই কাটিয়ে দেব।” |
|
|
|
|
|