একটা অদ্ভুত আঁধার? যে অন্ধকারে চাপা পড়ে রয়েছে অপরাধের বীজ? লিখছেন
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
খুব চেঁচিয়ে বলছি, ধর্ষকদের শাস্তি চাই। কঠিন শাস্তি। খুব তাড়াতাড়ি। পুলিশ দ্রুত কাজ করুক। আদালত দ্রুত চলুক। প্রত্যেক অপরাধের তুরন্ত শাস্তি হোক। নিরাপদ রাত-দিনে মেয়েদের অধিকার আছে, এ কথা মান্য হোক। নতুন ধর্ষণের আবেগে যেন পুরনো অপরাধের বিচার ফাইল-বন্দি না হয়ে থাকে। প্রতিবাদ হোক, জনসভা হোক। শান্ত ও অশান্ত মিছিল হোক। লাখ-লাখ মানুষ মোমবাতি হাতে পথে হাঁটুক, ধরনা হোক, আইন বদলানোর দাবি উঠুক। যত বড় অপরাধ, তত তীব্র শাস্তি হোক।
বেশ। কিন্তু আমরা কিছু মিস করছি না তো? এমন কিছু, যা খুব প্রাথমিক? ফান্ডামেন্টাল? হেলাফেলা করে ছড়িয়ে রয়েছে সামনেই, আমরা দেখতে পাচ্ছি না? দেখতে চাইছি না? এই যেমন মুম্বইয়ের শক্তি মিলস। পুরনো দুর্গের ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছে একদা গর্জন-হাঁকড়ানো কাপড়ের কল। অসাধারণ সবুজে চোবানো এমন নয়নলোভন ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাক্সিমাম সিটির বুকে বিরাজ করছিল বলেই তো চিত্র-সাংবাদিক মেয়েটি কনে-দেখা আলোয় ছবি তুলতে গিয়েছিল। যে ছবিতে ফুটে উঠতে পারত আশ্চর্য বৈপরীত্য। ঝাঁ-চকচক শহরের মাঝখানে খন্ডহর। |
অতীতের ধ্বংসাবশেষ ধারণ করেছে এই মিল। শিল্পের অতীত। মুম্বই শহরে এক কালে রাজত্ব করত অনেক কাপড়ের কল। ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসার শহর আগে শিল্পেরও শহর ছিল। শ্রমিকের শহরও ছিল বইকী সে। শ্রমিকরা অনেকে কষ্টেই থাকতেন। মাসের শেষে ধার করতে হত। ফ্রি’তে চিকিৎসার জন্য যেতে হত কোনও সহৃদয় ডাক্তারের কাছে বা সরকারি হাসপাতালে। ছেলেমেয়েরা গরিব স্কুলেই যেত। অনেকের বাবা হয়তো মদ খেয়ে ফিরত, মা’কে পেটাতও। কিন্তু তারই মধ্যে একটা বহতা জীবন ছিল। সামনে তাকানোর একটা ইচ্ছে ছিল। ছিল একটা কমিউনিটি। আর সবার ওপরে ছিল শ্রমিক শ্রেণির একটা নিজস্ব সম্মান। যে সম্মানটা ছিল তার কাজের অভিজ্ঞান।
তার পর এক দিন ধস নামল। মন্দা, লকআউট, ধর্মঘট, দত্ত সামন্ত, শিবসেনা... মিলগুলো ক্রমশ উঠে গেল। মরে গেল। শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে, জীবন হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন। সব নিরাপত্তা রাতারাতি ভ্যানিশ। এ দিক ও দিক ছিটকে পড়তে লাগল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। অর্থনীতির সাঁইসাঁই ঘূর্ণিতে দ্রুত বদলে যাওয়া শহরে ওই ছিটকে পড়া মানুষগুলো হয়ে উঠল উদ্বৃত্ত। শহুরে জীবনের উদ্বৃত্ত। উচ্ছিষ্ট। পড়াশোনা, নেই। ঠিকঠাক কাজের সুযোগ, নেই। আত্মসম্মান, নেই। অনেকেই ক্রাইমকে আঁকড়ে ধরল ক্ষমতার প্রতীক, ফ্রাসট্রেশনের বন্ধু, না-পাওয়ার রাগে ছিনিয়ে নেওয়ার অস্ত্র হিসেবে। অপরাধই তাদের একমাত্র সিলমোহর। এরা কিন্তু শহরেই থাকে।
কেবল মুম্বই শহরে থাকে, এমনটা নয়, ভারতের সব শহরেই ছেয়ে রয়েছে। শহরস্কেপে নতুন নয় এরা, আগেও ছিল। তবু, সাংঘাতিক সব অঘটন মুহুর্মুহু ঘটিয়ে ফেলত না, পটাপট রেপ করত না। কিন্তু এখন যেন একটা অন্ধকার গিলে খেয়েছে এই উদ্বৃত্তদের। চরম নিরাপত্তাহীনতার অন্ধকার। যখন অপরাধ ঘটে, যখন শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়, তখন এই অন্ধকারটা মালুম করতে পারি। তখন চোখ কচলে দেখি সেই অন্ধকারের দাঁত-নখ। যেমন এ বার দেখলাম শক্তি মিলস-এর কঙ্কালের আবডালে পাঁচ ধর্ষককে। ওরা এই ধারাতেই ক্রিমিনাল হয়ে উঠেছে কি না, জানি না। ওরা প্রতীক মাত্র। ওদের অপরাধের ইতিহাস হতে পারে অন্য। কিন্তু শক্তি মিলস-এর অনেক শ্রমিকের ছেলেই এখন হয়তো অপরাধী। কে জানে?
অপরাধকে তো কড়া হাতে দমন করতেই হবে। কিন্তু এই অদ্ভুত আঁধারটাকেও দেখতে হবে। বুঝতে হবে এই উদ্বৃত্ত, উচ্ছিষ্ট সমষ্টিকে। যত্ন নিতে হবে। সুষ্ঠু জীবনের আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এদের উন্নয়ন করলেই যে মেয়েরা নিরাপদ হয়ে যাবে, তা নয়। কিন্তু মূলের সমস্যাটাও খতিয়ে দেখতে হবে। চেষ্টা করে যেতে হবে এদের জন্য। তা যদি না হয়, তবে শাস্তি হলেই অপরাধ কমবে এমন ভরসা পাচ্ছি কই? |