সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, স্নাতক স্তরের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে পরিবেশ নিয়ে পড়তে হবে।
এ রাজ্যে এই নির্দেশের যে পরিণাম দাঁড়িয়েছে, তা আমাদের মানসিকতাকে চিনিয়ে দেয়। |
প্রথম দৃশ্য: ক্লাসে পড়াচ্ছেন পক্বকেশ ভদ্রলোক। তিনি ফলিত অঙ্কে রাজ্যে এক নম্বর বলে স্বীকৃত, সম্মানিত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ উপাচার্য পদ সামলেছেন। তাঁর পড়ানোর বিষয়: বাতাসে কার্বন কতটা মিশছে সেই হিসেব কষা। তাঁর সামনে বসে যাঁরা পড়া শুনছিলেন তাঁরা একটি নামী প্রতিষ্ঠানের স্নাতক স্তরের প্রথম বর্ষের ছাত্র। কারও বিষয় বাংলা, কারও ইংরেজি, কারও দর্শন, কারও বা ইতিহাস। বিদগ্ধ ওই পণ্ডিতের ওই ম্যাথমেটিকাল ক্যালকুলেশনস মাথায় ঢুকছিল না ক্লাসে থাকা নব্বই জন ছাত্রছাত্রীর। কেউ মোবাইলে এসএমএসে ব্যস্ত। কেউ বা আঁকিবুঁকি কাটছিলেন খাতায়।
দ্বিতীয় দৃশ্য: দক্ষিণ শহরতলির এক কলেজের ইতিহাসের শিক্ষিকা মহা বিপদে পড়েছেন। তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ ডেকে বলে দিয়েছেন পরিবেশবিজ্ঞান পড়াতে হবে। স্বামীর এক বন্ধুর কাছে সপ্তাহে দু’দিন পরিবেশের পাঠ নিয়ে আসেন তিনি। যে দিন ক্লাস থাকে তার আগের দিন। সেই কবে মাধ্যমিকে ভৌতবিজ্ঞান আর জীবনবিজ্ঞান পড়েছেন। তার পরে আর যোগই নেই বিজ্ঞানের সঙ্গে। পরিবেশ নিয়ে সংবাদপত্রে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। টিভিতে আলোচনাও শুনেছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যে পড়াতে হবে, তা তিনি জীবনে কোনও দিনও ভাবেননি।
প্রতিটি নাগরিককে পরিবেশবান্ধব করে তোলার জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিদান: স্নাতক স্তরের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে আবশ্যিক ভাবে পরিবেশ নিয়ে পড়তে হবে। পাশ করলেই হবে। এই নির্দেশের পরিণামে শহরের নামী প্রতিষ্ঠান নিজেদের সুনাম রাখতে ক্লাস নেওয়াচ্ছে অঙ্কের পণ্ডিতকে দিয়ে। আর দক্ষিণ শহরতলির কলেজটির সামর্থ্য নেই। তাই তারা ইতিহাসের শিক্ষিকাকে দিয়েই কাজ সারছে। |
ছাত্রছাত্রীরা কতটা পরিবেশসচেতন হলেন? প্রথম দৃশ্যের কুশীলব দুই ছাত্রীর মন্তব্য, “পার্সেন্টেজটা ঠিকঠাক রাখতে হবে। তাই ক্লাসে আসা। আর যে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে পাশ নম্বর বাঁধা, সেগুলি সব সময়েই পরীক্ষার আগে বলে দেওয়া হয়। সুতরাং কুছ পরোয়া নেই।” দ্বিতীয় দৃশ্যের এক ছাত্রের চটজলদি জবাব, “ক্লাসে না এলেও পাশ করার মতো নম্বর তুলতে পারতাম। কিন্তু কলেজের হাজিরা খাতায় নিয়মিত নাম তোলাটা আরও জরুরি।”
শিক্ষকরা কী বলছেন? শহরের নামী প্রতিষ্ঠানে পরিবেশের পাঠ দেওয়া প্রবীণ অঙ্কবিশারদের মন্তব্য, “ওরা শুনছে কি না জানি না, কিন্তু কিছু যে শিখছে না তা হলফ করে বলতে পারি।” আর ওই ইতিহাসের শিক্ষিকা বলছেন, “আমিও কিছু না বুঝেই পড়াচ্ছি খাতা দেখে। আর ছাত্রছাত্রীরাও নোট নিয়ে নিচ্ছে।”
আমাদের এখানে পরিবেশ বিষয়টিকে কী ভাবে দেখা হয়, তা এতদ্দ্বারা পরিষ্কার। দেখনদারির কিন্তু শেষ নেই। একের পর এক কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরে পঠনপাঠন শুরু হয়ে গেল বিশ্বভারতী, কলকাতা, কল্যাণী, বর্ধমান। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ম নিল স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ, মেরিন সায়েন্সেস। প্রেসিডেন্সিও পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকত্তোর স্তরে একটি কোর্স খুলে ফেলল। কোথাও পরিবেশ বিজ্ঞান খোলা হল প্রাণিবিজ্ঞান শাখার প্রচেষ্টায়। কোথাও আবার ভূবিজ্ঞান দফতর দায়িত্ব নিল। কোথাও উদ্ভিদ বিজ্ঞান, কোথাও বা রসায়ন বিভাগের উদ্যোগে খোলা হল পরিবেশ বিজ্ঞানের পৃথক পাঠ্যক্রম।
পরিবেশ বিজ্ঞান সত্য সত্যই একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট। রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, অঙ্ক, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, শারীরবিদ্যা, ভূবিজ্ঞান, আবহবিজ্ঞান, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োটেকনোলজি, ফার্মাকোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, নিউট্রিশন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং, সব কিছু মিলেই পরিবেশ বিজ্ঞান। কিন্তু এখানে যে সব দফতর নোডাল দফতর হল, তারা মনে করল পরিবেশ বিজ্ঞান মানে রসায়ন, কিংবা প্রাণিবিদ্যা, কিংবা উদ্ভিদ বিদ্যা। আর, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলি যার যার নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে গেল। কেউ কোনও দূষণকারী বস্তুর রাসায়নিক গুণাগুণ শিখল, মানুষের দেহে তার কী প্রতিক্রিয়া, তা শিখল না। কী ভাবে পরিবেশকে ওই থেকে মুক্ত করা যায় তাও না-জানা থেকে গেল।
একটা জগাখিচুড়ি বিদ্যা নিয়ে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরা যখন নিজেদের জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চাইল, তখন দেখা গেল বস্তুতপক্ষে তারা কিছু শিখেই আসেনি। এদের মধ্যে একমাত্র প্রেসিডেন্সিতেই পরিবেশ বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর শাখাটিতে (এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট) কিছুটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি গন্ধ ছিল। অঙ্ক, রসায়ন, ভূবিদ্যা, প্রাণিবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, সব শাখারই শিক্ষকদের বাইরে থেকে এনে, তাঁদের সঙ্গে হাতেকলমে কাজ করে পরিবেশকে জানার একটা চেষ্টা তৈরি হয়েছিল। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরে মেন্টর গ্রুপের সদস্যেরা ওই বিভাগটি পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু চলতি বছর থেকে ওই বিভাগে ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই বিভাগে পড়াতেন, এমন এক সর্বজনবিদিত পরিবেশবিদের মন্তব্য, “প্রেসিডেন্সি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়ের উপরে বেশি জোর দিচ্ছে, তার মডেল হতে পারত এনভায়রনমেন্টাল সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট। মেন্টর গ্রুপের সঙ্গে আমাদের বৈঠকে আমরা এ-রকমই একটা ধারণা পেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম এই বিভাগে স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হোক।” হল তার উল্টো।
পরিবেশ বিজ্ঞান চর্চার এই হাল কি আসলে পরিবেশ সম্পর্কে এ রাজ্যের সামগ্রিক ঔদাসীন্যেরই একটা পরিণাম? প্লাস্টিকের অবাধ ব্যবহার বন্ধ হয়নি রাজ্যে, দুই একটি জায়গায় যেখানে হয়েছে, তা হয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। মাটির তলায় আর্সেনিক আর ফ্লুওরাইড মিলছে নতুন নতুন এলাকায়, তা নিয়ে জনসচেতনতার কোনও প্রয়াস সরকারি তরফে নেই। দ্রুত নগরায়ণের ফলে বায়ু দূষণ বাড়ছে সর্বত্র, মানুষের হেলদোল নেই। আদালতের কড়া নির্দেশে অবশেষে বন্ধ হয়েছে পেট্রোলচালিত অটো রিকশা, কিন্তু তাও শুধু বৃহত্তর কলকাতার জন্য। রাজ্য জুড়ে জলাশয় বুজিয়ে বাড়ি হচ্ছে, জমির চরিত্র বদলে যাচ্ছে। গাছ কাটা হচ্ছে শহরে গ্রামে। জঙ্গলের ধার ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে রিসর্ট। সমুদ্রের বালিয়াড়ির মধ্যেই গড়ে উঠেছে হোটেল। আইন আছে আইনের নিজের মতো।
এখানে পরিবেশ দফতরের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতর, কিংবা পরিবেশ দফতরের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য দফতরের কোনও সমন্বয় নেই। মাঝেমধ্যে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরের আলোচনাচক্র হয় শহরে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বিশাল মিছিল বের হয়। টি শার্ট বিলি হয়। কাজের কাজ কিছু হয় না।
পরিবেশ বিষয়টি নিয়ে আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা অদ্ভুত ভাবে উদাসীন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ না থাকলে বামফ্রন্ট সরকার পরিবেশ দফতর বলে কোনও আলাদা দফতর তৈরি করত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছে। এখনও উঠছে। আর গত সরকার সব সময়েই পরিবেশ মন্ত্রী হিসেবে যাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদের কেউ মেয়াদ ফুরনোর আগেই মারা গিয়েছেন, কেউ অসুস্থ থাকায় দফতরটিকে দেখভালই করতে পারেননি। রাজ্যে ২০১১ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে সরকারি তরফে অবহেলা কাটেনি। পরিবেশের জন্য আলাদা কোনও মন্ত্রী নেই। যিনি রয়েছেন তাঁর হাতে রয়েছে পূর্ত দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর। ওই দফতরের দায়িত্ব সামলে তিনি পরিবেশ দফতরে সময় দেবেন কী ভাবে? সেই মানসিকতারই প্রভাব পড়েছে পরিবেশ নিয়ে পঠনপাঠনেও। দায়সারা ভাবে আর যা-ই করা যাক, পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করা যায় না। |