এখনকার সমস্যা তো আছেই। তা ছাড়া চলতি বছরের শেষের দিকে অনেকটা বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে,
তা ছাড়া অতি-স্বল্পমেয়াদি ঋণও আছে। ফলে ডলারের নির্গমন চলবেই। ডলারের দাম অন্তত
৭০ টাকার দিকে এগোচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মূল্যবৃদ্ধির গতি বাড়তে পারে।
দেশের বাজারে পেট্রোলিয়মজাত পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কাও আছে। |
দেশের অর্থনীতির হাল খারাপ। ২০১১ সালে প্রকৃত জিডিপির বৃদ্ধি হয়েছিল ৬.২ শতাংশ, ২০১২-১৩’য় ৫ শতাংশ। কৃষি ও শিল্প সহ প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে বৃদ্ধির গতি কমেছে। ২০১২-১৩’র ত্রৈমাসিক পর্বগুলিকে আলাদা করে দেখলে ছবিটা আরও ম্লান দেখায়। এখন আয়বৃদ্ধির প্রবণতা যে-রকম, তাতে পাঁচ শতাংশে পৌঁছনোও কঠিন। লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির এই ঝিমিয়ে পড়া অবস্থাতেও পঞ্চাশটির বেশি দেশের জাতীয় আয় বার্ষিক ৫ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে। ‘ব্রিক’ (ব্রাজিল, রাশিয়া ইন্ডিয়া, চিন) থেকে ইন্ডিয়াকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। আয়বৃদ্ধির তিনটি প্রধান চালিকাশক্তি আছে। কোনটির কী হাল দেখা যাক।
এক, রফতানি। চলতি আর্থিক বছরের (২০১৩-১৪) প্রথম তিন মাসে রফতানির অগ্রগতি কিছুটা ভদ্রস্থ হয়েছে বটে, কিন্তু তার অনেকটাই খুব নিচু থেকে শুরু করলে উন্নতিটা বেশি দেখায় বলে। বস্তুত, চলতি বছরে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৫০,০০০ কোটি ডলার থেকে নামিয়ে ৩২,৫০০ কোটি ডলার করা হয়েছে। টাকার দাম কমার ফলে রফতানির হয়তো কিছুটা সুবিধে হবে, কিন্তু রফতানির জন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশের শিল্পের সমস্যাগুলি রীতিমত প্রবল। তা ছাড়া, বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্তত আরও দু’বছর মন্দার হাওয়া চলবে, ফলে রফতানির চাহিদা স্তিমিত থাকবে।
দুই, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটার টান। নতুন প্রকল্প আগের চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। পুরনো প্রকল্পগুলি নানা ধরনের বাধায় আটকে আছে বা ঢিমেতালে চলছে। পরিকাঠামো বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি এই বাধাগুলি দূর করার ব্যাপারে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। এ দিকে, সুদের হার চড়া, এবং মূল্যবৃদ্ধির যে অবস্থা, তাতে সুদ কমার ভরসা নেই। সুতরাং বিনিয়োগে জোয়ার আসবে বলে মনে হয় না।
তিন, ভোগব্যয়। সাম্প্রতিক তথ্যের অভাব, তবে ২০১২-১৩’য় ভোগব্যয়ের বৃদ্ধি-হার আগের চেয়ে কমেছে। ২০১১-১২’ ভোগব্যয় বেড়েছিল ৭.৯ শতাংশ, পরের বছরে বেড়েছে ৪ শতাংশ।
সুতরাং, আয়বৃদ্ধির সব ক’টি বড় উৎসই সীমিত। সরকারও আয়বৃদ্ধির গতি বাড়ানোর জন্য বিশেষ কিছু করতে পারেনি। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফ ডি আই) নিয়ে খুচখাচ চেষ্টায় বিশেষ কিছু লাভ হবে না।
মূল্যবৃদ্ধির কী অবস্থা? জুন মাস পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে পাইকারি বাজারদরের সূচক বার্ষিক ৫.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু খুচরো বাজারের ছবিটা অনেক বেশি উদ্বেগজনক। ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সাম্প্রতিকতম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে জুলাই মাসের জন্য। গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় দাম বেড়েছে ৯.৬৪ শতাংশ। জুনের চেয়ে একটু কম হতে পারে, কিন্তু রীতিমত চড়া। খাবারের দাম অনেক কমবে, এমন আশার কোনও কারণ নেই। উৎপাদন এবং পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে নানা সমস্যা আছে, তার ওপর ডলারের চড়া দামের ঠেলায় অনেক শিল্পের উপকরণের দাম হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে, ফলে শিল্পজাত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও কমার কারণ নেই। এই অবস্থায়, অর্থমন্ত্রী যতই আশ্বাস দিন যে রাজকোষ ঘাটতি চলতি বছরের শেষে জিডিপি’র ৪.৮ শতাংশের লক্ষ্যেই বেঁধে রাখা হবে, সুদের হার বোধহয় কমবে না। (রাজকোষ ঘাটতি বেঁধে রাখার জন্য অর্থমন্ত্রী সম্ভবত সরকারের মূলধনী ব্যয় কাটছাঁট করবেন।)
সব মিলিয়ে বলা চলে, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিরাট কোনও সংকট নেই, কিন্তু আয়বৃদ্ধি স্তিমিত, মূল্যবৃদ্ধি চড়া এবং কর্মসংস্থানের গতি শ্লথ। নির্বাচনের আগে এই ছবি পালটাবে না। সংকট বলতে যা বোঝায়, সেটা হল বৈদেশিক ক্ষেত্রে। ২০১৩ মার্চ মাসে মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৯,০০০ কোটি ডলার, তার প্রায় ২৫ শতাংশ হল স্বল্পমেয়াদি ঋণ। তখন বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ২৯,২০০ কোটি ডলার। ২০১২-১৩’য় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি খাতে ঘাটতি ছিল ৮,৮০০ কোটি ডলার, মূলধনী খাতে আসা ৮,৯০০ কোটি ডলার দিয়ে সেই ঘাটতি মেটানো হয়। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০১৩-১৪ সালে চলতি খাতে ঘাটতি জিডিপি’র ৩.৭ শতাংশে সীমিত রাখা হবে। কিন্তু বাজার যে ভাবে চলছে, তাতে এই অনুপাত ৪.৫ শতাংশের কাছাকাছি হওয়ার কথা। আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, ডলার খরচের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছে, তার ফলে হয়তো ঘাটতি কিছুটা টেনে দেওয়া যাবে, কিন্তু অর্থনীতির যুক্তিতে এগুলো আসলে উল্টোপথে হাঁটার শামিল। তার উপরে মূলধনী খাতেও বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন কার্যত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
তবে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হল, মূলধনী খাতে ডলারের আগমনে প্রবল ভাটার টান চলছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ (এফ আই আই) এবং প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফ ডি আই), উভয় ক্ষেত্রেই বিদেশি পুঁজি আসছে না। মার্কিন অর্থনীতির টানাপড়েন এর একটা কারণ। মনে রাখতে হবে, ১৯৯১ সালের মতো আজ আর টাকার দাম সরকারি নির্দেশে বেঁধে রাখা হয় না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক টাকা এবং ডলারের বিনিময়-হারকে একটা সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করে বটে, কিন্তু বাজারের তাড়নায় টাকার দাম পড়লে আটকে রাখা আজ সম্ভব নয়। আর, বিদেশি মুদ্রার বাজারে যে কোনও ভাবে হস্তক্ষেপ করতে গেলে তার খরচা আছে। চলতি বছরের শেষের দিকে অনেকটা বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে, তা ছাড়া অতি-স্বল্পমেয়াদি ঋণও আছে। ফলে ডলারের নির্গমন চলবেই। ডলারের দাম অন্তত ৭০ টাকার দিকে এগোচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আই এম এফের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে, যাতে দরকার হলে বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায়। টাকার দাম কমবার ফলে মূল্যবৃদ্ধির গতি বাড়তে পারে। দেশের বাজারে পেট্রোলিয়মজাত পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কাও আছে।
বিদেশি মুদ্রার সংকট মোকাবিলার একটা উপায় হয়তো ছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করা। কিন্তু ভোট শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, এই অবস্থায় এতটা সাহস কি আর সরকারের হবে? অর্থনীতি সাহস দাবি করে, কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে সাহসের স্থান নেই।
|
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ |