বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেসু) দ্বিতীয় বর্ষের পাঁচ জন ছাত্র র্যাগিংয়ের দায়ে এক বছরের জন্য প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাস হইতে বহিষ্কৃত। তাহারা পরীক্ষায়ও বসিতে পারিবে না এবং তাহাদের একটি বৎসর নষ্ট হইবে। র্যাগিংয়ের ঐতিহ্যটি এ দেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগেরই। পুরানো ছাত্র এবং প্রতিষ্ঠানের রীতি-রেওয়াজের সহিত নবাগতদের পরিচিত করাইবার পদ্ধতি হিসাবেই ইহা চালু হইয়াছিল। কিন্তু কালক্রমে নবাগতদের উপর পুরাতনদের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করিতে শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক ব্ল্যাকমেল-এর মতো অনাচারে এই ঐতিহ্যটি অধঃপতিত হয়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং বিশেষত শ্রীলঙ্কার প্রযুক্তি ও চিকিৎসাশাস্ত্র শিখিবার সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে র্যাগিং হইয়া ওঠে নবাগত ছাত্রদের পক্ষে এক আতঙ্কস্বরূপ।
ক্রমশ র্যাগিংয়ের শিকার নবাগতরা বহু সংখ্যায় আহত হইতে থাকেন। শারীরিক নিগ্রহ ও মানসিক লাঞ্ছনা-অপমানের শিকার হইয়া কেহ-কেহ এমনকী আত্মহননের চরম পন্থাও বাছিয়া লন। এ সংক্রান্ত সংবাদ দেশময় প্রচারিত হইলে তাহার তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শীর্ষ আদালতের বিচারপতিরা পর্যন্ত এই অনাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান লইতে কর্তৃপক্ষকে আর্জি জানায়। অতঃপর অনেক রাজ্যে র্যাগিংকে দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ রূপে গণ্য করিবার আইনও পাশ হয়। তাহার পরই র্যাগিংয়ে লিপ্ত সিনিয়র ছাত্রদের সাজা দিবার কড়াকড়ি কলেজে-কলেজে শুরু হইয়াছে। বেসু’র ঘটনা তাহারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। প্রায়শ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির কর্তৃপক্ষের তরফে র্যাগিংয়ের ঘটনা অস্বীকার করার কিংবা চাপিয়া যাওয়ার অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ইহাতে র্যাগিংয়ের অনাচারই উৎসাহিত হয়। ধরা পড়ার কিংবা পড়িলেও শাস্তি না-পাওয়ার নিশ্চয়তা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের বেপরোয়া করিয়া তোলে। পরিণামভয়হীন হইয়া তাহারা নবাগতদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়াইয়া দেয়। কলেজ ও ছাত্রাবাসগুলিতে সুস্থ পরিবেশ ফিরাইয়া আনিতে বিভিন্ন উদ্যোগ লওয়া হইয়াছে। কড়া আইন প্রণয়ন তাহার অন্যতম। কেবল কঠোর আইনে কাজ হইবে না, তাহা দৃঢ়তার সহিত বলবৎ করা হইতেছে কি না, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্যই কলেজে, প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং-বিরোধী কমিটি গড়িয়া নজরদারি চালু করার, নিগৃহীত ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় গোপনের নিরাপত্তা দিয়া অভিযোগ জানাইতে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা শুরু। কর্তৃপক্ষও র্যাগিংয়ে লিপ্ত ছাত্রদের প্রতি প্রশ্রয়ের মনোভাব ত্যাগ করিয়া ইহাকে নিন্দনীয় অপরাধ রূপে গণ্য করিতে শেখেন। সকল প্রতিষ্ঠান-পরিচালক যে র্যাগিংয়ের প্রতি একই রকম কড়া মনোভাব পোষণ করেন, এমন নয়। এখনও অনেকেই ইহাকে ‘স্বাভাবিক’, ‘ছোটদের দুষ্টুমি’ কিংবা ‘জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার আবশ্যিক প্রস্তুতিপাঠ’ বলিয়া মনে করেন। কিন্তু ক্রমশই নবাগতদের উপর এই অনাচারের মর্মান্তিক পরিণাম দেখিয়া সমাজে ইহার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়িয়া উঠিতেছে। কয় দিন আগে কলিকাতার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভিন্ রাজ্যের কয়েক জন নবাগত ছাত্র র্যাগিং সহ্য করিতে না পারিয়া কলেজ ও ছাত্রাবাস ছাড়িয়া বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছে। তাহার পরই বেসু’র এই কাণ্ড। কর্তৃপক্ষ যে পত্রপাঠ অভিযুক্তদের সাজা দিতে উদ্যোগী হইয়াছেন, এ জন্য তাঁহারা ধন্যবাদার্হ। |