ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্যভঙ্গ লইয়া সম্মিলিত হাহাকার অতি তারসপ্তকে চড়িয়াছে। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ঠিক নাই, তাহা সন্দেহাতীত। কিন্তু অসুস্থতা যেখানে, আর যাহা লইয়া হাহাকার চলিতেছে, দুইটি বিষয় অভিন্ন নহে। হাহাকারের প্রধান কারণ দুইটি: টাকার দাম প্রবল বেগে পড়িতেছে; শেয়ার বাজার নিম্নমুখী। অনেক দেশেই মুদ্রার পতন হইতেছে, কিন্তু ভারতীয় টাকা সেই দৌড়ে প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছে। উদ্বেগ অহেতুক নহে। কিন্তু পতনের মূল কারণটি বুঝিয়া লওয়া সমধিক জরুরি। টাকার দাম বেশ কয়েক বৎসর অস্বাভাবিক রকম চড়িয়া ছিল। তাহার একটি বড় কারণ, ২০০৮-এর মন্দার পর ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লগ্নি করিতে বিনিয়োগকারীদের অনীহার ফলে ভারতীয় বাজারে বিস্তর বিদেশি মুদ্রা ঢুকিয়াছিল। এখন সেই লগ্নি বিপরীতমুখী। ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্কের ন্যায় দেশগুলিতেও একই ঘটনা ঘটিতেছে। বলা চলে, এই মুহূর্তে টাকার দামের সংশোধন চলিতেছে। তাহা বাড়িয়া-কমিয়া একটি স্তরে স্থিতু হইবে। সেই স্তর অবশ্য ২০১০-১১ সালের সঙ্গে তুলনীয় হইবে না। ‘নূতন স্বাভাবিক স্তর’ মানিয়া লওয়া ভিন্ন উপায় নাই। শেয়ার বাজারের পতনও অপ্রত্যাশিত নহে, ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার আর্থিক সংকট স্মর্তব্য। শেয়ার বাজার বা টাকার দাম লইয়া উদ্বেগ অহেতুক নহে, কিন্তু ‘শেষের সে দিন ভয়ংকর’ গোত্রের আতঙ্ক অপ্রয়োজনীয়। ক্ষতিকরও।
শেয়ার বাজার বা টাকার দাম মূল সমস্যা নহে, তাহার উপসর্গমাত্র। ভারতের সমস্যা অন্যত্র। সেই সমস্যার সন্ধান পাওয়া যাইবে অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের দশ দফা ব্যবস্থাপত্রে। যে সমাধানসূত্রের কথা তিনি বলিয়াছেন, তাহাতে নহে এখনও যে এই কথাগুলি এমন ভাবে বলিতে হইতেছে, মূল সমস্যা তাহাই। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, তিনি অবিলম্বে যে কাজগুলি করিবেন, তাহার কয়েকটি নিম্নরূপ: রাজকোষ ঘাটতি এবং বাণিজ্য খাতে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ, বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণবৃদ্ধি, দেশে বিনিয়োগের প্রক্রিয়াকে বাধাহীন করা, উৎপাদন এবং রফতানি খাতে উৎসাহ দেওয়া, কয়লা এবং লৌহ আকরিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার দ্রুত নিষ্পত্তি করা। কোন কথাটি নূতন? কোন কথাটি অর্থমন্ত্রীর অজানা ছিল? তবুও, অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলি বকেয়া রহিয়া গিয়াছে। ভারতের সমস্যা এইখানেই। দেশটি যে ভাবে চলিতেছিল, তাহাতে অর্থনীতির গতিভঙ্গ সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র। অপেক্ষা ফুরাইয়াছে। অর্থমন্ত্রীর ব্যবস্থাপত্রে বাজার আশ্বস্ত হয় নাই। হওয়ার কথাও ছিল না। যে নীতিপঙ্গুত্ব ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফার অভিজ্ঞান, তাহা হঠাৎ উধাও হইয়া যাইবে, এমন কল্পনাবিলাস সম্পূর্ণ অভাবনীয়। অর্থমন্ত্রীর জন্য আরও বিনিদ্র রজনী অপেক্ষা করিতেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাইয়াছে। ফলে, বাণিজ্য খাতে ঘাটতি আরও বাড়িবে। মূল্যস্ফীতিও ঊর্ধ্বমুখী হইবে। আর্থিক বৃদ্ধির হার কমায় কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও কমিবে। ফলে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণও অর্থমন্ত্রীর নির্ধারিত লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করিতে পারে। উদ্বিগ্ন হইয়া চটজলদি সমাধান খুঁজিতে গেলে বিপদ আরও বাড়িবে অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ইউপিএ সরকারের সুনাম নাই। সমস্যা কাঠামোগত, তাহার সমাধানও সেই দিক হইতে করাই বিধেয়। অর্থমন্ত্রী অবিলম্বে ভর্তুকি ছাঁটুন। নির্বাচনের কথা ভাবিবার সময় ইহা নহে। উৎপাদন ক্ষেত্রে মন দিন, তাহার যথার্থ পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করুন। তাঁহার ব্যবস্থাপত্রে যে কথাগুলি তিনি বলিয়াছেন, তাহাই যথার্থ পথ। প্রশ্ন সেই পথে তাঁহার চলিবার ক্ষমতা, ইচ্ছা এবং বিচক্ষণতা লইয়া। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা না রাখিলে বিপদ আরও বাড়ে কথাটি অর্থমন্ত্রী স্মরণে রাখিবেন কি? |