|
|
|
|
|
|
মিউচুয়াল ফান্ড |
|
আঁধার সুড়ঙ্গ পেরিয়ে
টাকার যা হাল আর বাজারের যা দশা, তাতে মিউচুয়াল ফান্ড সন্ত্রস্ত্র।
যেন ছড়িয়ে পড়েছে আঁধার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ার আতঙ্ক। ঘাবড়াবেন না।
ঠান্ডা মাথায় সঠিক সিদ্ধান্তই কিন্তু আলোর দেখা পাওয়ার চাবিকাঠি
নীলাঞ্জন দে |
|
অস্থির,
ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত, পতনোন্মুখ ঠিক কোন শব্দটা ব্যবহার করলে মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের এখনকার অবস্থাটা একেবারে ১০০% ঠিকঠাক তুলে ধরা যাবে সেটাই ভাবছি। কারণ এই মুহূর্তে বহু ফান্ডেরই পারফর্ম্যান্স খুব খারাপ। লগ্নিকারীরা অত্যন্ত অখুশি এবং সন্ত্রস্ত। তাঁরা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন, যেখান থেকে ফান্ডে ঢালা তহবিলের মূল্য আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই ক্রমশ বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর সেই ভয়ের মেঘ যত ঘন হচ্ছে, অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় তত তাঁরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় কী করণীয় তাঁদের? অন্ধকার পেরিয়ে আলোর মুখ দেখার জন্য এ বার ঠিক কোন রাস্তাটা নেবেন তাঁরা? চলুন জেনে নিই।
ফিরে দেখুন
ফান্ডে লগ্নির প্রাথমিক বিষয়গুলি হল সম্পদ বরাদ্দ, ফান্ড নির্বাচন ও তহবিল বণ্টন। তিন ক্ষেত্রেই এখন লগ্নির কৌশল পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। খুঁজে বার করতে হবে এই বিষয়গুলির মধ্যে জড়িয়ে থাকা নির্দিষ্ট ঝুঁকির দিকগুলি। তার পর সেগুলি দূর করার উপায় স্থির করতে হবে। এর জন্য সব থেকে প্রথমে নিজের লগ্নির সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্নের জবাব খতিয়ে দেখুন:
• রিটার্ন পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ফান্ড ম্যানেজারের অতীত পারফর্ম্যান্স কেমন?
• ফান্ডে লগ্নি করা তহবিল বণ্টন করা হয়েছে কী ভাবে?
• কোন ক্ষেত্রে বেশি টাকা ঢালা হয়েছে, কোথায় কম?
• নানা ধরনের শেয়ার ও ঋণপত্রে তহবিল আরও ছড়িয়ে (ডাইভার্সিফিকেশন) দেওয়ার কোনও উপায় আছে কি?
• লগ্নি করতে মোট খরচ পড়ছে কত?
• খরচ কি ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে, না কি তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকছে?
|
|
ময়নাতদন্ত জরুরি
লগ্নি-কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে গেলে সমস্ত শর্তই কাটাছেঁড়া করতে হবে। না-হলে এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমন:
১) প্রত্যেক লগ্নিকারীই ফান্ডে টাকা খাটিয়ে বেশি রিটার্ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। তাই ফান্ডের ভাল-মন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসলে, প্রথমেই তার সাম্প্রতিক পারফর্ম্যান্সের খবর নিতে হবে। পাশাপাশি বাজারে একই চরিত্রের অন্য যে-সব ফান্ড রয়েছে, সেগুলি এত দিন কেমন রিটার্ন দিয়েছে সেটাও যাচাই করে দেখতে হবে। তবে এ সবই করা জরুরি আগামী দিনে আপনার ফান্ডের রিটার্ন দেওয়ার ক্ষমতা আন্দাজ করার জন্য। আগের ভাল রেকর্ড দেখে অতিরিক্ত আশান্বিত হয়ে পড়বেন না। কারণ, অতীতের ফলের পুনরাবৃত্তি ভবিষ্যতেও যে-হবে, তার কোনও মানে নেই।
২) যে-ম্যানেজমেন্ট দল আপনার ফান্ড পরিচালনা করছে, তাদের ফান্ডে রিটার্ন পাইয়ে দেওয়ার অতীত রেকর্ড খতিয়ে দেখুন। বিষয়টি বিচার করুন অন্তত গত ১০ বছর মেয়াদের ভিত্তিতে।
৩) তহবিল বণ্টনের বিষয়টি পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ফান্ড ম্যানেজার নির্দিষ্ট নীতি মেনে আপনার অর্থ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে বা ভাগ করে দিচ্ছেন। যে-সব ক্ষেত্রে তহবিল ছড়িয়ে দেওয়া হল, তারা যদি ভাল মুনাফা দেয়, আপনার কপাল খুলবে। সুতরাং তহবিল বণ্টনের উপরই শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে রিটার্নের পরিমাণ। তাই প্রথমে লক্ষ্য করুন, কোন ক্ষেত্রে তহবিলের সব থেকে বেশি অংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। যাচাই করুন আপনারটির সমগোত্রীয় যে সব ফান্ড বাজারে রয়েছে, তারা কোন ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়েছে। এ বার দুইয়ের মধ্যে তুলনা টেনে ভাল-মন্দ বিচারের চেষ্টা করুন।
৪) আপনার ফান্ডটি পুরোপুরি শেয়ার নির্ভর হতে পারে। কিংবা তার একটা অংশ শেয়ারে খাটতে পারে। যাই হোক না-কেন, সেটি যে নির্দিষ্ট সূচককে বেছে নিয়ে এগোবে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে তহবিল বণ্টনের বিষয়টি। অর্থাৎ খুব জরুরি শর্ত হল, কোন ধরনের শিল্পে খাটানোর জন্য কত টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এখন যদি দেখা যায় যে, মাত্র দু’একটি শিল্পেই (যেমন ভোগ্যপণ্য, গাড়ি ইত্যাদি) বণ্টিত হয়েছে তহবিল, তা হলে ওই শিল্পগুলির আর্থিক অবস্থা থেকে ফান্ডের সম্ভাব্য পারফর্ম্যান্সের আন্দাজ পাবেন।
৫) ভেবে দেখুন, ফান্ডের তহবিল আরও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে (ডাইভার্সিফাই) দেওয়ার সুযোগ আছে কি না। তহবিল যত বেশি নানা ধরনের শিল্পে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, ভাল রিটার্নের সম্ভাবনা তত বাড়ে। কারণ সাধারণত সব শিল্প একসঙ্গে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যায় না। ফলে একটি থেকে রিটার্ন খারাপ হলে অন্যটি পুষিয়ে দিতেও পারে। এতে সার্বিক ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই কমে। তবে ভাবনা-চিন্তা না করে, গায়ের জোরে শুধুমাত্র বেশি শেয়ারে তহবিল ছড়িয়ে দিতে হবে বলেই তা করে বসবেন না। লগ্নির দুনিয়ায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট পরিকল্পনা করে নেওয়া উচিত। যেমন ধরুন, আপনার ফান্ড যদি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট ভাল পারফর্ম করে থাকে, তা হলে শুধু শুধু লগ্নির টাকা অন্য সংস্থার শেয়ারে ভাগ করে আরও লাভের সম্ভাবনায় ইতি না-টানাই ভাল।
৬) এই বাজারে শুধু ছোট ও মাঝারি সংস্থার (স্মল ক্যাপ) শেয়ারে ফান্ডের তহবিল খাটিয়ে বড় রিটার্নের স্বপ্ন দেখা ঠিক হবে না। তার জন্য ফান্ডে অবশ্যই কিছু বড় সংস্থার (লার্জ ক্যাপ) শেয়ার থাকতে হবে।
৭) এ বার আসি খরচের প্রসঙ্গে। একজন লগ্নিকারী হিসেবে ফান্ডে লগ্নির যাবতীয় খরচ সম্পর্কে প্রথম থেকেই যথেষ্ট সচেতন থাকা উচিত। জানা উচিত ফান্ড ম্যানেজারকে কত টাকা ফি দিতে হবে। প্রত্যেক বার লেনদেন-সহ আরও নানা খাতে খরচ বহন করতে হয়। তা-ও স্পষ্ট জেনে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রেও একই চরিত্রের অন্যান্য ফান্ডের খরচ সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। তুলনা করে দেখুন বাড়তি টাকা বার করতে হচ্ছে না তো? খরচের বিষয়টি কিন্তু রিটার্নের অঙ্কের উপর অনেকটা প্রভাব ফেলে। |
ঝুঁকি কোথায় |
• রিটার্নের উপর ফান্ড পিছু খরচের প্রভাব অনেকখানি। কারণ খরচ বাড়লে রিটার্ন কমবে।
• শ্লথ আর্থিক বৃদ্ধি, আঁটোসাঁটো নগদের জোগান, বাড়তে থাকা ঘাটতি, বহু কর্পোরেট সংস্থার মুনাফা হ্রাস ও পরিকাঠামোর মতো বেশ কিছু শিল্পে বৃদ্ধি মন্থর হওয়া-সহ একাধিক বিষয়ের প্রভাব এড়ানো মুশকিল।
• মূল্যবৃদ্ধি বাড়লে ফান্ডও চাপে থাকবে।
• এই মুহূর্তে ইক্যুইটি (শেয়ার ভিত্তিক) বা ডেট ফান্ড (ঋণপত্র নির্ভর), কোনওটিকেই সম্পূর্ণ নিরাপদ বলা যাবে না।
• বেশি ওঠা-পড়া চলছে এমন শিল্পে ফান্ডের তহবিল খাটলে ঝুঁকি বাড়বে।
• রক্ষণশীল লগ্নিকারীদের ঝুঁকির ফান্ড থেকে দূরে থাকাই ভাল।
• এই বাজারে বৈচিত্র্য কম হলেও ঝুঁকিবিহীন ফান্ড বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। |
|
এই অবস্থায় কী করবেন?
যদি এরকম দাঁড়ায় যে, বাজারের অবস্থা শোধরানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং আরও বিগড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা হলে কী করবেন? তাই এ বার বলছি।
১) ফান্ডের পারফর্ম্যান্সের উপর নিয়মিত নজর রাখুন। দেখুন কতটা লোকসান হতে পারে। লক্ষ্য রাখুন শেয়ার বাজারের ওঠা-পড়ার দিকে। অন্তত এই মুহূর্তে সেই বিষয়গুলির খবর রাখার চেষ্টা করুন, যাদের উপর শেয়ার সূচকের ওঠা-নামা নির্ভর করে।
২) বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রগুলিও পাল্টে নিন।
৩) ফান্ডের পিছনে খরচের বিষয়টি খুব খুঁটিয়ে যাচাই করতে থাকুন। দেখুন, হঠাৎ খরচ যেন মাত্রাছাড়া না হয়ে যায়।
৪) অনেক দিন ধরে লোকসান দিচ্ছে এমন ফান্ড থেকে বেরিয়ে আসার কথা ভাবতে পারেন এই সময়ে।
৫) বাজারের অস্থিরতার প্রভাব এড়াতে তুলনায় কম ঝুঁকির ফান্ডে তহবিল সরাতে পারেন। যাতে বাজার খুব বেশি ওঠা-নামা করলেও আপনার ফান্ডের উপর তার আঘাত কম পড়ে।
৬) সঙ্কটের বাজারে খুব বড় রিটার্নের লোভ করার তুলনায় লোকসান এড়িয়ে ভদ্রস্থ মুনাফা ঝুলিতে পোরার দিকে লক্ষ্য রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। |
লেখক উইশলিস্ট ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজর্সের ডিরেক্টর
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|