|
|
|
|
|
|
সিইও-র টেবিল থেকে |
বাছুন সেই সংস্থা, যারা টাকা ফেরতে আপসহীন |
সারদা কাণ্ডের রেশ মেলায়নি এখনও। আর সেই কারণে প্রতিটি স্থানীয় সঞ্চয় সংস্থাই আতস কাচের তলায়। এর আগেও সঞ্চয়িতা কালো ছায়া ফেলেছে বাজারে। তৈরি করেছে অবিশ্বাসের আবহ। কিন্তু কোনও কিছুই পেড়ে ফেলতে পারেনি আশি বছরের পুরনো সঞ্চয় সংস্থা পিয়ারলেস-কে। কী করে? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে সেই ইঙ্গিত, যা থেকে টাকা রাখার নির্ভরযোগ্য জায়গা বেছে নেওয়া শিখতে পারেন লগ্নিকারী। দক্ষ আর যত্নশীল হতে পারেন সঞ্চয় সংস্থা বাছার বিষয়ে। যাতে কষ্টে রোজগারের টাকা আলেয়ার পিছনে ছুটে হারিয়ে না-যায়। বরং তা পাথেয় হয় সুরক্ষিত ভবিষ্যতের। একান্ত আলোচনায় স্মৃতির ঝাঁপি উজাড় করলেন পিয়ারলেসের কর্ণধার সুনীল কান্তি রায় |
|
• সঞ্চয়িতা বা সারদা চড়া সুদের প্রতিশ্রুতিতে সঞ্চয়ের টাকা তুলে ব্যবসা করা অনেক সংস্থাকেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে দেখেছে এই রাজ্য। কিন্তু হাজারো ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও টিকে থেকেছে পিয়ারলেস। কী ভাবে?
আমি বিশ্বাস করি, আমানত সংগ্রহ করা মানে আমি আসলে কিছু দিনের জন্য অন্যের টাকার ‘কাস্টোডিয়ান’। তাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, মেয়াদ শেষে রিটার্ন সমেত তা ফিরিয়ে দেওয়া। যে-কারণে দু’বছর আগে আমানত সংগ্রহের ব্যবসা গুটিয়ে দেওয়ার পরেও সংস্থা লগ্নিকারীদের টাকা এখনও ফিরিয়ে চলেছে। আমানতের মেয়াদ যেমন-যেমন ফুরোচ্ছে, তেমন-তেমন আমরা টাকা মিটিয়ে চলেছি। এমনকী মেয়াদ শেষের পর কেউ টাকা না-তুললে, সংস্থাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
• আর্থিক সংস্থা হিসেবে আপনারা দীর্ঘ দিন ব্যবসা করছেন। ব্যবসায় টিকে থাকার চাবিকাঠিটি কী?
প্রায় ৮০ বছর ধরে আমরা আর্থিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ আমাদের দিকে আঙুল তোলার সুযোগ পায়নি। এই সাফল্যের ভিত্তি সৎ উদ্দেশ্য, আইন মেনে ব্যবসা করার শপথ আর যে কোনও মূল্যে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার জেদ।
• কিন্তু কেন বদলে ফেলতে হল ব্যবসার মডেল?
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেছিল পিয়ারলেসও। কিন্তু পরে ওই আর্থিক লেনদেনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তার পর ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে আইনের ফাঁক খোঁজার কোনও চেষ্টা করিনি আমরা। বরং আমানত (ডিপোজিট) সংগ্রহের পুরনো পথ ছেড়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি ব্যবসার মুখ। খুঁজে নিয়েছি লাভের নতুন উৎস। আইন মেনে ব্যবসা করে প্রায় আট দশক টিকে থাকার এই উদাহরণ আজকের নানা আর্থিক কেলেঙ্কারির বাজারে দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে আমি মনে করি।
|
|
• সৎ ভাবে ব্যবসা করার দাবি করছেন। কী ভাবে?
আমাদের মতো আরএনবিসি (রেসিডুয়ারি নন ব্যাঙ্কিং কোম্পানি) সংস্থাকে সংগৃহীত টাকা কোথায় কতটা রাখতে হবে, তা রীতিমতো নিয়ম করে বেঁধে দিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যার মধ্যে ছিল ব্যাঙ্কের স্থায়ী আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট), সরকারি ঋণপত্র (বন্ড) ইত্যাদি। বলা হয়েছিল, ফেরতের টাকা আলাদা ভাবে তুলে রাখতে হবে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ১৯৮৭ সাল থেকে এই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করেছিল। কিন্তু পিয়ারলেস নিজে থেকেই তা চালু করেছিল তার প্রায় দশ বছর আগে। আমরা ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলাম। সেই চুক্তি অনুযায়ী, টাকা লগ্নি করে হাতে আসা নথি (যেমন স্থায়ী আমানত, বন্ডের সার্টিফিকেট ইত্যাদি) রাখা হত ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের কাস্টোডিয়ান অ্যাকাউন্টে। ব্যাঙ্কের সঙ্গে চুক্তি ছিল, আমানতকারীদের প্রকল্প যেমন-যেমন ম্যাচিওর করবে সেইমতো নথি (স্থায়ী আমানত, বন্ড ইত্যাদির) অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে তা ভাঙিয়ে আমানতকারীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করব আমরা। আমি মনে করি আর্থিক সংস্থা হিসাবে এটি ‘সেল্ফ ডিসিপ্লিনের’ একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যে-কোনও আর্থিক সংস্থারই এই নিয়ম-নিষ্ঠা থাকা একান্ত জরুরি।
• বেশি সুদ দেওয়াকেই বেসরকারি সংস্থাগুলি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলার মূল কৌশল হিসেবে ব্যবহার করত। আপনারাও কি তা-ই করতেন?
সৎ ভাবে ব্যবসা করলে, বাজারে চালু হারের তুলনায় অনেক বেশি সুদ দেওয়া অসম্ভব। তাই সেই প্রতিশ্রুতি কখনওই পিয়ারলেস দেয়নি। বরং আমাদের কাছে লোকে টাকা রাখত ভাল পরিষেবা পাওয়ার জন্য। প্রতি দিন অল্প অল্প করে জমানো টাকা সপ্তাহ বা মাসের শেষে আমাদের কর্মীদের হাতে তুলে দিতেন তাঁরা। মিলত গোষ্ঠী বিমার মতো বাড়তি সুবিধাও।
• আপনারা ছিলেন রেসিডুয়ারি নন ব্যাঙ্কিং কোম্পানি বা আরএনবিসি। আইন পাল্টেছে। ওই ব্যবসা আর করা সম্ভব নয়। কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করছেন?
আইন পাল্টায়। সেই বদলের সঙ্গে পা মিলিয়ে ব্যবসার অভিমুখ বদলে ফেলাই কোনও বেসরকারি আর্থিক সংস্থার টিকে থাকার চাবিকাঠি বলে আমি মনে করি। শর্ত, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনেরও। নিয়ম মানার ওই চ্যালেঞ্জ কোনও সংস্থা নিতে পারবে কি না, আখেরে সেটাই ঠিক করে দেবে তার ভবিষ্যৎ। বুঝিয়ে দেবে, আদৌ সংস্থাটি লম্বা দৌড়ের ঘোড়া কি না। ঠিক যে ভাবে ওই দক্ষতা পিয়ারলেস-কে একেবারে আলাদা করে দিয়েছে অন্য অনেক আইনি বা বেআইনি আর্থিক সংস্থার থেকে।
আগেই বলেছি, গোড়ায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের ব্যবসা করত পিয়ারলেস। কিন্তু পরে আরএনবিসি-র টাকা তোলার উপর আইনের ফাঁস ক্রমশ শক্ত করতে থাকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সেই সময়ে পিয়ারলেস এবং আরও একটি সংস্থাই ছিল দেশের প্রধান দুই আরএনবিসি সংস্থা। উভয় সংস্থাকেই টাকা তোলা বন্ধ করতে বলে শীর্ষ ব্যাঙ্ক। সেই সঙ্গে নির্দেশ দেয়, আমানতকারীদের সব টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার। সেই অনুযায়ী, ২০১১ সালে আমানত সংগ্রহ বন্ধ করি আমরা। সেই সঙ্গে মেয়াদ যেমন-যেমন শেষ হচ্ছে, সেই অনুযায়ী সুদ সমেত টাকা মিটিয়ে দেওয়াও শুরু হয়।
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও আমানত সংগ্রহের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আইনের ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায়নি পিয়ারলেস। মেনে নিয়েছিল ওই ব্যবসা বন্ধের সিদ্ধান্ত। যে-কারণে ব্যবসার মডেলই পুরোদস্তুর বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই আমরা। চালু করি ‘ফিনান্সিয়াল প্রোডাক্ট ডিস্ট্রিবিউশন’ নামে ব্যবসার নতুন বিভাগ। যার আওতায় রয়েছে মিউচুয়াল ফান্ড, জীবন বিমা, সাধারণ বিমা, স্টক ব্রোকিং (শেয়ার কেনা-বেচা) ইত্যাদি। সেই সঙ্গে বাড়তি জোর দেওয়া হয় আগেই চালু করা হোটেল, হাসপাতাল এবং রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আবাসন গড়ার ব্যবসায়।
এই নয়া ব্যবসার মূলধনও কিন্তু আমানতকারীদের টাকা নয়। পুরোটারই সংস্থান করা হয়েছে পিয়ারলেসের সংরক্ষিত তহবিল থেকে। যা মূলত শেয়ারহোল্ডারদের টাকা। |
সাক্ষাৎকার: প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী |
|
|
|
|
|