লগ্নির টিপ্স |
কষ্টের সঞ্চয়ে সুরক্ষার খোঁজ
টাকা তলানিতে। অর্থনীতি বেসামাল। এই অবস্থায় কষ্টে রোজগারের টাকা
রাখবেন কোথায়? ঝুঁকির শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ড ছেড়ে সনাতন
ব্যাঙ্ক আর ডাকঘরই কি তবে একমাত্র ভরসা?
অমিতাভ গুহ সরকার
|
|
|
যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমানে কোন জিনিসের ক্ষয় সব থেকে বেশি? চট করে যে-উত্তর এখন অনেকের মাথায় আসবে, তা হল ‘টাকা’। যার মূল্যক্ষয় এখন অত্যন্ত তীব্র। দাম নামছে রোজই। সে ডলারেই হোক বা পণ্যমূল্যের। তা হলে মানুষ সঞ্চয় করবেন কেন? সঞ্চয়ের অর্থ ভবিষ্যতে ভোগের লক্ষ্যে বর্তমানে ত্যাগ। কিন্তু একনাগাড়ে টাকা পড়তে থাকলে ভবিষ্যতের জন্য কতটা মূল্য বাঁচবে এই প্রশ্ন এখন অনেকেরই মনে। সুদ দিয়েও সামলানো যাচ্ছে না এই ক্ষয়। ১০০ টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে বছর ঘুরলে মিলতে পারে বড়জোর ৯ টাকা। ২০% কর বাদ দিলে পড়ে থাকবে ৭.২০ টাকা। অন্য দিকে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ১০% হলে ১০০ টাকায় আগে যা কেনা যেত বছর শেষে সে জন্য লাগবে ১১০ টাকা। কিন্তু হাতে আছে ১০৭.২০ টাকা। অর্থাৎ এক বছর অপেক্ষা করেও কমবে ক্রয়ক্ষমতা। তা হলে সঞ্চয়ের যুক্তি কী? কোনও যুক্তি নেই, কিন্তু সঞ্চয় করতে হবে। কারণ দেশে তেমন সামাজিক সুরক্ষা নেই। শেষ বয়সে সব দায়িত্ব সরকার নেবে না। আপনাকেই বইতে হবে টাকার মূল্যক্ষয় হলেও।
পরের প্রশ্ন, টাকা কোথায় রাখবেন? কিছু দিন আগে পর্যন্ত হয়তো ঝুঁকি নিয়ে সঞ্চয়ের একাংশ শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে ঢেলেছেন। এখন উত্তরাখণ্ডকেও বোধহয় হার মানিয়েছে শেয়ার বাজারের ধস। যত সস্তাতেই পাওয়া যাক, মানুষ এখন ওই পাড়া মাড়াতে নারাজ। তা হলে উপায়? সনাতন ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর। যেন বলছে, যে-কোনও পরিস্থিতিতেই আমাকে মনে রেখ। মূল টাকা খোয়া যাবে না। সুদ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে না-পারলেও কাছাকাছি থাকবে। আয় কম হলেও নিশ্চয়তা আছে।
অর্থাৎ এই দুর্যোগের বাজারে খোঁজ করতে হবে নিশ্চয়তাযুক্ত স্থির আয় প্রকল্পের। দুর্যোগ না-কাটা পর্যন্ত তাঁবু ফেলতে হবে এখানেই। ছোট করে আলোচনা করা যাক প্রকল্পগুলি নিয়ে।
ব্যাঙ্ক আমানত
চিট ফান্ডের দৌরাত্ম্য কমায় এবং শেয়ার বাজার ঝুলে পড়ায় বহু মানুষ ফিরছেন ব্যাঙ্ক আমানতে। এতে ব্যাঙ্কগুলিরও সুবিধা। কারণ ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা থেকে মোটা টাকা শুষে নিয়েছে। আসুন দেখে নিই ব্যাঙ্কে জমার গুণ:
• সুরক্ষা
• সুদের নিশ্চয়তা
• মেয়াদ নির্বাচনের সুবিধা
• মেয়াদের আগে ভাঙানোর সুযোগ
• ঋণের সুবিধা
• ১৫ জি / ১৫ এইচ জমা দিয়ে (উপযুক্ত ক্ষেত্রে) উৎসে কর না-কাটার সুবিধা
• বাড়ির কাছে ব্যাঙ্কের শাখা/ এটিএমের সুবিধা
• ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাঙ্কিং
• সুদ জানা থাকায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সুবিধা
• নিয়মিত টাকা জমাতে আছে রেকারিং ডিপোজিট
• প্রবীণ ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষের জন্য মাসিক বা ত্রৈমাসিক আয়ের ব্যবস্থা
• সুদ তুলে না-নিলে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে ওঠার সুবিধা
• সময় মতো টাকা ফেরতের নিশ্চয়তা
• ৮০সি ধারায় কর সাশ্রয়কারী আমানতের সুবিধা। |
|
ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প
আগের জনপ্রিয়তা ফিরে পেতে শুরু করেছে বিভিন্ন ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পও। দূরদূরান্তের মানুষ নিশ্চিন্তে টাকা রাখতে পারেন ভারত সরকারের এই দফতরে। এখানে টাকা রাখার সুবিধাগুলি হল:
• প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন রকম প্রকল্প
• সরকারের দেওয়া সুরক্ষা
• বর্তমান বাজারে অনুযায়ী আকর্ষণীয় সুদ
• ৮০সি ধারায় করসাশ্রয়কারী প্রকল্প
• পিপিএফ অ্যাকাউন্টে করমুক্ত সুদের সুবিধা
• অবসরপ্রাপ্তদের জন্য মাসিক আয় প্রকল্প
• প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিশেষ প্রকল্প
• কয়েকটি প্রকল্পে কর না-কাটার সুবিধা।
সঙ্গের সারণিতে দেওয়া হল বিভিন্ন প্রকল্পের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি।
বন্ড-ডিবেঞ্চার
স্থির আয় প্রকল্প হিসেবে মন্দ নয়। কোম্পানি বাছতে হবে সাবধানে। উঁচু রেটিংযুক্ত হলে ভাল। অনেক সরকারি কোম্পানি বন্ড ইস্যু করে। কোম্পানি থেকে সরাসরি বন্ড কিনে পুরো মেয়াদ ধরে রাখলে বাজারের ওঠা-পড়াজনিত ঝুঁকি থাকে না। অনেক বন্ড নথিবদ্ধ হয় শেয়ার বাজারের বন্ড বিভাগে। এগুলি প্রয়োজনে বিক্রি করে বেরিয়ে আসা যায়। গত দু’বছর বাজারে ছাড়া হচ্ছে করমুক্ত বন্ড। বাকি সব বন্ডের সুদ করযোগ্য। এ বার মোট ১৩টি সংস্থাকে ৪৮,০০০ কোটি টাকা মূল্যের করমুক্ত বন্ড ইস্যু করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ আসতে শুরু করবে এগুলি। উঁচু হারে করদাতাদের জন্য আদর্শ লগ্নির জায়গা। মূলধনী লাভকর বাঁচাতে লগ্নি করতে পারেন ক্যাপিটাল গেইনস্ বন্ডে। এতে দেওয়া হচ্ছে করযোগ্য ৬% সুদ। রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন কর্পোরেশন ও ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি ইস্যু করে এই বন্ড। উঁচু রেটিংযুক্ত বন্ড ভাল হলেও সাবধানে থাকতে হবে ভুঁইফোঁড় কোম্পানির রেটিংবিহীন ডিবেঞ্চার থেকে।
প্রেফারেন্স শেয়ার
এই শেয়ারে বাজারজনিত ঝুঁকি থাকে না। কেনার সময়েই জানা যায় মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত বাৎসরিক ডিভিডেন্ডের হার। যা করমুক্ত। তবে বাজারে নথিবদ্ধ হয় না বলে প্রেফারেন্স শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে আসা শক্ত। আর ডিভিডেন্ড দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার লাভ হলে তবেই। এই কারণে কোম্পানি বাছতে হবে সাবধানে। প্রেফারেন্স শেয়ার কিউমুলেটিভ হলে ভাল হয়।
কোম্পানি জমা প্রকল্প
এক সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিল। পরে বেশ কিছু কোম্পানি সময় মতো টাকা ফেরত দিতে না-পারায় আস্থা হারায় জন আমানত প্রকল্প। সারদার মতো কোম্পানির কার্যকলাপে আস্থা আরও তলানিতে। এই পরিস্থিতিতেও ভাল আমানত টানছে কয়েকটি গৃহঋণ প্রদানকারী সংস্থা। কোম্পানি আমানত প্রকল্পের সুদ পুরোপুরি করযোগ্য। উৎসে ১০% কর কাটা হয় বাৎসরিক সুদ ৫০০০ টাকার বেশি হলে।
এফএমপি
মিউচুয়াল ফান্ডের ফিক্সড ম্যাচিওরিটি প্ল্যান (এফএমপি)-ও ছোট থেকে মাঝারি মেয়াদে ভাল লগ্নির জায়গা হতে পারে, বিশেষ করে উঁচু হারে করদাতাদের জন্য। |
প্রাপ্তির খতিয়ান |
প্রকল্প |
লগ্নির পরিমাণ (টাকা) |
(ন্যূনতম) |
(সর্বাধিক) |
|
মেয়াদ |
আয়
সুদের হার (%) |
সুরক্ষা |
আগে
ভাঙানোর
সুবিধা |
করযোগ্যতা |
অন্যান্য |
ব্যাঙ্ক আমানত |
১,০০০ থেকে
১০,০০০ |
ঊর্ধ্বসীমা
নেই |
৭ দিন থেকে
১০ বছর |
৮.৭৫/৯.০
(সর্বাধিক) |
শ্রেষ্ঠ |
আছে |
করযোগ্য
টিডিএস
আছে |
প্রবীণ নাগরিকদের
জন্য ০.২৫-০.৫০%
অতিরিক্ত সুদ |
ডাকঘর মাসিক
আয় প্রকল্প
(এম আই এস) |
১,৫০০ |
৪.৫ লক্ষ
/৯ লক্ষ |
৫ বছর |
৮.৪ |
শ্রেষ্ঠ |
আছে, ১
বছর পর |
করযোগ্য
টিডিএস নেই |
অবসরপ্রাপ্ত মানুষের
জন্য উপযুক্ত |
জাতীয় সঞ্চয়পত্র
(এন এস সি) |
১০০ |
নেই |
৫ বছর থেকে
১০ বছর |
৮.৫
৮.৮ |
শ্রেষ্ঠ |
সাধারণত
নেই |
করযোগ্য
টিডিএস নেই |
মূল লগ্নি এবং বার্ষিক
সুদের উপর ৮০-সি
ধারায় কর ছাড় |
পাবলিক প্রভিডেন্ট
ফান্ড (পি পি এফ) |
৫০০ |
বার্ষিক
১ লক্ষ |
১৫ বছর |
৮.৭ |
শ্রেষ্ঠ |
আছে
আংশিক |
করমুক্ত |
৫ বছর করে মেয়াদ
বাড়ানো যায় |
সিনিয়র সিটিজেন
সেভিংস স্কিম |
১০০০ |
১৫ লক্ষ |
৫ বছর |
৯.২ |
শ্রেষ্ঠ |
১ বছর পর
বন্ধ করা যায় |
করযোগ্য
টিডিএস আছে |
৮০-সি ধারায়
কর ছাড় মিলবে |
ডাকঘর টাইম
ডিপোজিট |
২০০ |
নেই |
১ বছর
২ বছর
৩ বছর
৫ বছর |
৮.২
৮.৩
৮.৪
৮.৫ |
শ্রেষ্ঠ |
আছে |
করযোগ্য |
ঋণের সুবিধা আছে |
কোম্পানি বন্ড
/ডিবেঞ্চার |
৫০০০ |
নেই |
৩ থেকে
২০ বছর |
বিভিন্ন |
রেটিং অনুযায়ী |
আছে/নেই |
করযোগ্য/
করমুক্ত |
অনেক বন্ড বাজারে
নথিভুক্ত হয় |
কোম্পানি
আমানত |
বিভিন্ন |
নেই |
১ থেক
৩ বছর |
৯-১২ |
খাতাকলমে
সুরক্ষিত নয় |
আছে |
করযোগ্য
টিডিএস আছে |
|
|
|
লেখক ম্যাকলিওড রাসেল ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোম্পানি সেক্রেটারি
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|