প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে পরিকাঠামোগত নানা সমস্যা নিয়েই রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা পরিষেবা দেন তাঁরা। তবু রোগীর কোনও কিছু হলে তাঁদেরকেই কাঠগড়ায় তোলা হয়। এই সব কিছুকে সঙ্গী করেও নিজেদের সেবাকাজের এক নজির রাখলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। শুধু চিকিৎসা পরিষেবাই নয়, চিকিৎসার জন্য নিজেদের পকেট থেকে অর্থ খরচ করে তাঁরা দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন এক দুঃস্থ ব্যক্তির।
পেশায় কাঠের মিস্ত্রি শম্ভু পাত্র ক্যানিংয়ের বিদ্যাধর কলোনির বাসিন্দা। স্ত্রী পরিচারিকার কাজ করে কোনওরকমে সংসার টানেন। এই অবস্থায় রক্তে সুগারের পরিমাণ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার কারণে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে থাকে শম্ভুবাবুর। কিন্তু চরম অভাবের সংসারে স্বামীরঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছিলেন না স্ত্রী পদ্মদেবী। ফলে যা হওয়ার তাই হল। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি হারালেন শম্ভুবাবু। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না পদ্মদেবী। পরিবারটির এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে আসেন স্থানীয় একটি ক্লাবের ছেলেরা। তাঁদের উদ্যোগে এবং প্রতিবেশী গৌর সরকার নামে এক যুবকের চেষ্টায় অসুস্থ শম্ভুবাবুকে গত মার্চ মাসে ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। গৌরবাবুর কথায়, “পাড়ার লোকজনের কাছে শম্ভুবাবুর অবস্থার কথা জানতে পেরে হাসপাতালের চিকিৎসক সমর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওঁকে ভর্তি করি। ওষুধপত্র ও চিকিৎসার জন্য চাঁদা তুলে কিছু টাকাও তুলে দেওয়া হয়েছিল।” কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসার যে ন্যূনতম খরচ তাও দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না পরিবারটির। এই অবস্থায় এগিয়ে আসেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। |
ক্যানিং হাসপাতালের চিকিৎসক সমর রায় বলেন, “আমরা যখন চিকিৎসা শুরু করি, তখন কোনওভাবেই ওঁর সুগার কমানো যাচ্ছিল না। এমনকী কলকাতায় স্থানান্তরিত করার মতো অবস্থা ছিল না। তবে আমরা হাল ছাড়িনি। জেদ চেপে গিয়েছিল ওঁকে সুস্থ করে তুলতেই হবে।” হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, নিয়মিত চিকিৎসায় ধীরে ধীরে শম্ভুবাবুর সুগার কমতে থাকে। নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় তা আসার পরে গত ২৩ অগস্ট শম্ভুবাবুর চোখে অস্ত্রোপচার করেন হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ পার্থপ্রতিম দত্ত। সফল অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছেন শম্ভুবাবু। তবে এখনও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাননি।
হাসপাতালের সুপার ইন্দ্রনীল সরকার বলেন, “শম্ভুবাবুকে যখন স্থানীয় কিছু ছেলে হাসপাতালে ভর্তি করে তখন ওঁর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। রোগী কল্যাণ সমিতি এবং হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এগিয়ে আসায় ওঁর চিকিৎসা সম্ভব হয়েছে।”
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এ দিন নিজের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য বার বার কপালে হাত ঠেকাচ্ছিলেন শম্ভুবাবু। চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়ে কেমন লাগছে জানতে চাওয়ায় তার উত্তর না দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন তাঁর, “কেন বার বার কপালে হাত ঠেকাচ্ছিলাম বলুন তো?” কেন? এ বার উত্তর এল, “এতদিন ভগবানকে ডেকেছি, এখানে এসে সেই ভগবানের দেখা পেলাম। যাঁরা আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁরা ছাড়া আর কাকে প্রণাম করব?”
আর পদ্মদেবীর কথায়, “স্বামী ঠিকই বলেছেন। ডাক্তারবাবুরা না থাকলে ওঁকে ফিরে পেতাম না। তাই ওঁরাই আমাদের কাছে ভগবান।” |