লেখাপড়া করে যে, জলপানি পায় সে। এই আশায় এতদিন বুক বেঁধেছে গরিব পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা। এ বার নিয়মটা উল্টে দিল রাজ্যের সংখ্যালঘু দফতর। রাজ্য সরকারের স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য পেতে হবে ৫০ শতাংশের কম নম্বর। তার বেশি নম্বর পেলে বাদ। অন্য দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের শর্ত, বৃত্তির আবেদন করতে চাই ন্যূনতম ৫০ শতাংশ। যদিও রাজ্যের জন্য যা অর্থ বরাদ্দ, তাতে নম্বর বেশ উঁচু না হলে স্কলারশিপ মেলে না। ফলে রাজ্যে প্রায় ১৭ হাজার সংখ্যালঘু পড়ুয়া দুই দিক থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় বৃত্তি পাওয়ার পক্ষে তাদের নম্বর কম, কিন্তু রাজ্যের বৃত্তির পক্ষে বেশি।
|
২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হয়েছে ‘কম প্রতিভাবান’ সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের সহায়তার প্রকল্প (‘আন্ডারট্যালেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য মাইনরিটি স্টুডেন্টস’)। সেরাদের ছেড়ে কেন পিছিয়ে-পড়াদের দিকে ঝোঁক? রাজ্যের সংখ্যালঘু বিত্ত ও উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান আবু আয়েশ মণ্ডলের ব্যাখ্যা, “বাম আমলে মেধার ভিত্তিতে স্কলারশিপ দেওয়ার রীতি ছিল। আমরাও ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে তা অনুসরণ করেছিলাম। কিন্তু তাতে মুষ্টিমেয় মেধাবী ছাত্রছাত্রী টাকা পান। বাইরে থেকে যান আরও অসংখ্য পড়ুয়া। তাঁদের লেখাপড়ার খরচ কে দেবে? আমরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব করি, যাতে ৫০ শতাংশের কম নম্বর পাওয়া পড়ুয়াদের স্কলারশিপ দেওয়া যায়। তিনি তা মেনে নেন।”
রাজ্যের সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ চালু হয় ২০০৯-১০ সালে। শর্ত ছিল, পারিবারিক আয় বার্ষিক দু’লক্ষ টাকার কম, আর ন্যূনতম নম্বর চাই মাধ্যমিকে ৬৫ শতাংশ, উচ্চ মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ এবং স্নাতক স্তরে ৫০ শতাংশ। নতুন ব্যবস্থায় স্কলারশিপ পাওয়ার শর্ত হল, আবেদনকারীকে যে কোনও স্তরের সর্বশেষ পরীক্ষায় ৫০ শতাংশের কম নম্বর পেতে হবে। কমানো হয়েছে মাথাপিছু টাকার পরিমাণও (বক্স দেখুন)। আবু আয়েশের অবশ্য দাবি, “কেন্দ্র যে হারে স্কলারশিপ টাকা দেয়, সেই হারেই টাকার পরিমাণ স্থির হয়েছে। বেশি পড়ুয়াকে সুযোগ দিতে হলে মাথাপিছু টাকা তো কমবেই।”
তবে সংখ্যালঘুদের পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপের জন্য রাজ্যের মোট বরাদ্দ বেড়েছে। ২০১১-১২ পর্যন্ত রাজ্য সরকার ওই খাতে ২০ কোটি ২৩ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকা খরচ করেছে। ২০১২-১৩ থেকে সেটাই এক লাফে হয়েছে ৩৪ কোটি ৪৮ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা পড়ে গিয়েছেন বিপাকে। গত বছর নদিয়ার ধুবুলিয়া সুভাষচন্দ্র বালিকা বিদ্যালয় থেকে ৭০ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কল্যাণী মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন জারিন তাসনিম। তাঁর আক্ষেপ, “নম্বর বেশি থাকায় রাজ্যের স্কলারশিপ পাইনি। এ যে দেখছি, বেশি নম্বর পাওয়াই কাল হল।” একই কারণে বঞ্চিত হয়েছেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষার স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের পড়ুয়া সাত্ত্বক শেখ। গত বছর সাম্মানিক স্নাতক স্তরে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপের জন্য তিনি আবেদন করেছিলেন। তাঁর খেদ, “সারা বছর হাপিত্যেশ করে স্কলারশিপের টাকার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পেলাম না। জানি না, কী ভাবে পড়া চালাব।”
কী হবে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাওয়া, গবেষণার স্বপ্ন-দেখা মেধাবী এই পড়ুয়াদের? আবু আয়েশের দাবি, “মেধাবীদের অসুবিধা হবে না। অনেকেই তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তা ছাড়া কেন্দ্রের স্কলারশিপ তো আছেই।” কেন্দ্রের স্কলারশিপ পাওয়ার শর্ত, অন্তত ৫০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। সেই অনুসারে এ বছর ১ লক্ষ ২৩ হাজার ছাত্রছাত্রী মেধা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে সহায়তা পেলেও, এ রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাদ পড়ে গিয়েছেন ১৭ হাজার ছাত্রছাত্রী।
এর আগে কেন্দ্রের বরাদ্দ শেষ হওয়ার পর বাকি ছাত্রদের স্কলারশিপ দিত রাজ্য। এ বছর রাজ্যের শর্ত বদলে গিয়েছে। ফলে, ওই ১৭ হাজার ছাত্রছাত্রী রাজ্যের তালিকায় থাকা পড়ুয়াদের চাইতে মেধাবী হয়েও বাতিল হয়ে গেলেন। রাজ্যের
প্রাক্তন সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের প্রতিমন্ত্রী আবদুস সাত্তারের মতে, “এই নীতিতে রাজ্য সরকারের দিশাহীনতা ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব প্রকট।”
সংখ্যালঘু নিগম অবশ্য মনে করেন তাঁদের উদ্দেশ্য সফল, কারণ রাজ্যের স্কলারশিপ প্রাপকের সংখ্যা বেড়েছে চারগুণেরও বেশি। আবু আয়েশ বলেন, “আগে নম্বরের কড়াকড়ি থাকায় খুব কম ছাত্রছাত্রী টাকা পেতেন। এখন যে হারে স্কলারশিপ প্রাপকের সংখ্যা বেড়েছে, তাতেই প্রমাণিত যে আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।”
বেশি নম্বর পেয়েও বাদ পড়ল যে পড়ুয়ারা, তারা সহমত হবে কি? |
সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের বৃত্তি-চিত্র |
স্কলারশিপ |
নম্বর(শতাংশ) |
টাকা |
প্রাপক সংখ্যা |
পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ
ফর মাইনরিটি স্টুডেন্টস |
মাধ্যমিক ৬৫
উচ্চমাধ্যমিক ৬০ গ্র্যাজুয়েশন৫০
|
উচ্চমাধ্যমিক ৬০০০ টাকা
স্নাতক ৯০০০ টাকা স্নাতকোত্তর ১৪৪০০ টাকা
|
২৪,১৪৩
(২০১১-১২) |
আন্ডার ট্যালেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রাম
ফর মাইনরিটি স্টুডেন্টস |
শেষ পরীক্ষায়
সর্বোচ্চ ৪৯ |
উচ্চমাধ্যমিক ১৪০০-২৩৫০ টাকা স্নাতক ৩৩০০ টাকা
স্নাতকোত্তর ৫১০০ টাকা
|
১,০০,৫৯৩
(২০১২-১৩) |
|