বিধানসভা ভবনের দো’তলার একটি ঘরে আড়াই ঘণ্টার বন্দি জীবন। পাহারায় মার্শাল। তারই ফাঁকে দর্শনার্থী হিসাবে কখনও আসছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিএমের আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বা সুশান্ত ঘোষ, কখনও সদলবল কংগ্রেসের সতীর্থেরা। কখনও আবার চুপচাপ তৃণমূলের গুটিকয়েক বিধায়কও ঘুরে যাচ্ছেন! টেলিভিশন চ্যানেলে বসে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে ‘মর্যাদাহানিকর’ মন্তব্য করার অপরাধে এই হল কংগ্রেস নেতা তথা তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক অরুণাভ ঘোষের শাস্তি। সাজা শেষে মুক্ত অরুণাভবাবু ফের আক্রমণ করে বসলেন স্পিকারকেই!
|
বিধানসভায় অরুণাভ ঘোষ। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ আচার্য |
স্পিকারকে কটাক্ষ করে অরুণাভবাবু বিধানসভার অভিভাবক এবং সেই সঙ্গে গোটা সভার স্বাধিকার ভঙ্গ করেছেন বলে রিপোর্ট দিয়েছিল স্বাধিকার কমিটি। তদনুযায়ী সমন পেয়ে মঙ্গলবার বেলা আড়াইটেয় বিধানসভায় হাজির হয়েছিলেন আইনজীবী অরুণাভবাবু। অধিবেশন কক্ষে তৈরিই ছিল কাঠগড়া। প্রাক্তন বিধায়ক এসে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই স্পিকার বিমানবাবু রায় ঘোষণা করে বলেন, “দিনের অধিবেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অরুণাভবাবুকে মার্শালের হেফাজতে আটক করে রাখা হবে।” অরুণাভবাবু স্পিকারকে কিছু বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু স্পিকারের নির্দেশে মার্শাল তাঁকে দো’তলার একটি ঘরে নিয়ে চলে যান। অরুণাভবাবুকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়ার প্রতিবাদে এ দিন ওয়াকআউট করেন কংগ্রেস বিধায়কেরা। বিধানসভার পোর্টিকোয় তাঁরা স্পিকারের বিরুদ্ধে সরব হন।
কংগ্রেসের তরফে মানস ভুঁইয়া, অসিত মিত্র, মনোজ চক্রবর্তীদের প্রশ্ন, বিধানসভার আইনের ৩০৬ ধারার ২ উপধারায় আধ ঘণ্টা আলোচনার সুযোগ রয়েছে। অতীতে বিধানসভায় স্বাধিকার ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত সম্পাদক এম জে আকবর এবং রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি ভূপিন্দর সিংহকে শাস্তি শোনানোর আগে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। অরুণাভবাবুকে দেওয়া হল না কেন? স্পিকারের অবশ্য যুক্তি, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে স্বাধিকার কমিটির শুনানিতে ডেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সাজা ঘোষণার সময় তাঁকে বলতে দেওয়ার রেওয়াজ নেই।
যদিও বিধানসভা বিশেষজ্ঞ দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, স্পিকার চাইলে সাজা দেওয়ার আগে অরুণাভবাবুকে বলতে দিতেই পারতেন। সুদূর অতীতে সাতের দশকে অপূর্বলাল মুখোপাধ্যায় যখন স্পিকার, সিপিআইয়ের ইলা মিত্রের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের দায়ে সাংবাদিক কল্পতরু সেনগুপ্ত স্বাধিকার ভঙ্গে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সে দিন বলতে দেওয়া হয়েছিল। একই ভাবে আকবর নিজেকে নির্দোষ দাবি করার পাশাপাশি বিধানসভায় তাঁর হয়ে সওয়াল করেছিলেন সৌগত রায়। ডিজি ভূপিন্দর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই ভুল স্বীকার করে নেওয়ায় তাঁকে এক হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেস বিধায়ক মানসবাবুর প্রশ্ন, দোষ স্বীকার করুন বা পাল্টা যুক্তি দিন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ কেন অরুণাভবাবু পেলেন না? বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুর অবশ্য সহাস্য মন্তব্য, “আমার মনে হয়েছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের চেয়ে সরকারের স্বরূপ উন্মোচন করতে অরুণাভবাবু জেলে যেতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন!”
জেল থেকে বেরিয়ে অরুণাভবাবু স্বরূপে ফিরে গিয়েছেন। বলেছেন, “কেন শাস্তি পেলাম, জানলাম না!” স্পিকার বিমানবাবু কোনও আইনজীবীই নন বলে তীব্র কটাক্ষ করেন তিনি। বিধানসভার নিদানের প্রতিবাদে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার কথা বলেন। হাইকোর্ট চত্বরে এক দল আইনজীবী বিক্ষোভ দেখান।
আর অরুণাভ-কাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে অধিবেশন শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন-পর্বে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “আমরাও প্রাক্তন হলে এমন কোনও আচরণ বা মন্তব্য করব না, যাতে বিধানসভা বা অধ্যক্ষের মর্যাদাহানি হয়।” |