দেহরাদূন থেকে কিলোমিটার চারেক দূরে উদ্ধার হওয়া অসুস্থ বৃদ্ধাকে যখন ঠিকানা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শুধু বলতে পেরেছিলেন ‘শান্তিপুর’। বানভাসি উত্তরাখণ্ড থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁকে নিয়ে এসেছিল এ রাজ্যের শান্তিপুরে। কিন্তু পরিবারের খোঁজই মিলছিল না। বৃদ্ধাও বলছিলেন শুধু অসমের কথা। শেষ পর্যন্ত কর্মসূত্রে নিয়মিত অসমে যাওয়া দুই স্থানীয় যুবকই খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর আসল ঠিকানা। সেটা শান্তিপুরেই বটে। তবে ওই শান্তিপুর অসমের মঙ্গলদইয়ে।
মঙ্গলবার দুপুরে নদিয়ার শান্তিপুর থেকে নিজের শান্তিপুরে পাড়ি দিলেন বছর পঁচাত্তরের গোলাপি সরকার। তবে গত ১৪ দিন যেখানে রইলেন, রানাঘাটের বিশ্বাসপাড়ার সেই চক্ষু হাসপাতাল কিছু কম ‘নিজের’ ছিল না তাঁর। হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মী সকলেই ভালবেসে ফেলেছিলেন ছোটখাট চেহারার বৃদ্ধাকে। নাম দিয়েছিলেন ‘উত্তরাখণ্ডের মাসি।’ নার্স শীলা দাঁ, হাসপাতাল কর্মী প্রদীপ সাহা মঙ্গলবার দুপুর থেকে সকলেরই মুখ ভার।
আর ‘মাসি’? কালনা থেকে কামরূপ এক্সপ্রেস ধরতে ফেরিঘাটের দিকে রওনা হওয়ার আগে বললেন, “এখানে বেশ ভাল ছিলাম। তবে এ বার বাড়ি ফিরব।” গোলাপিদেবী অবশ্য জানেন না, উত্তরাখণ্ডে প্রকৃতির তাণ্ডবে তাঁর এবং তাঁর ছোট ছেলে মানিকের মৃত্যুই হয়েছে ধরে নিয়ে বড় ছেলে ইতিমধ্যে তাঁদের শ্রাদ্ধ করে ফেলেছেন। দুই প্রতিবেশী ও ছোট ছেলের সঙ্গে উত্তরাখণ্ডে বেড়াতে গিয়েছিলেন গোলাপিদেবী। বিপর্যয়ের পর সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। মানিকবাবু এখনও নিখোঁজ। যাত্রাসঙ্গী দুই প্রতিবেশী ফিরে গিয়ে পাড়ায় জানিয়েছিলেন, বন্যায় ভেসে গিয়েছেন মা-ছেলে। |
ও দিকে, উত্তরাখণ্ডে উদ্ধার হওয়া গোলাপিদেবীর মুখে ‘শান্তিপুর’ শুনে স্থানীয় এক বাঙালি ব্যবসায়ীই নাকি বাকিদের জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় শান্তিপুর নামে একটি জায়গা রয়েছে। গোলাপিদেবীকে আনা হয়েছিল দেহরাদূনে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাসপাতালে। ওই সংগঠনের সভাপতি বিজয় জায়সবাল বিষয়টি জানান তাঁদের রানাঘাট শাখাকে। কলকাতার এক বাসিন্দার সঙ্গে গোলাপিদেবীকে আনা হয় রানাঘাটে। সেই ১৪ অগস্ট থেকে এখানকার ওই চক্ষু হাসপাতালই হয়ে ওঠে বৃদ্ধার ঘরবাড়ি। আর তিনি হয়ে যান ‘উত্তরাখণ্ডের মাসি’।
হাসপাতালের বিছানায় ঘুম, ক্যান্টিনের খাবার, আর অনেকের ভালবাসা-যত্নে দিন কাটছিল মাসির। বাড়ির খোঁজটাও অবশ্য চলছিল একই সঙ্গে। রানাঘাটের মহকুমাশাসক সুপর্ণকুমার রায়চৌধুরীকে তাঁর কথা জানানো হয়। শান্তিপুর এবং রানাঘাট বিধানসভার ভোটার কার্ড দেখে ৪৩ জন গোলাপি সরকারের নাম পাওয়া যায়। অথচ সেই সব ঠিকানায় লোক পাঠিয়েও গোলাপিদেবীর পরিবারের হদিস মেলেনি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের রানাঘাট শাখার অন্যতম কর্তা মনোজ অগ্রবাল বলেন, “এখানে গোলাপিদেবীর ঠিকানা না মেলায় আমাদের সন্দেহ জাগে। মনে হয়েছিল কোথাও ভুল হচ্ছে।” গোলাপিদেবীর সঙ্গে গল্প করতে গিয়েও তাঁরা দেখেছিলেন, তিনি কখনও বলছেন অসমের কথা, কখনও বা গণেশ মন্দির বা বনদুর্গা মন্দিরের কথা। তখন মনোজবাবুরা দুই স্থানীয় যুবকের সাহায্য চান। ওই দু’জন রুপোর কাজ করার সুবাদে রানাঘাট থেকে নিয়মিত অসমে যাতায়াত করেন।
তাপস ও শেখর নামে ওই দুই রুপোর কারিগরই শেষ পর্যন্ত মঙ্গলদইয়ের শান্তিপুরে গোলাপিদেবীর বাড়ি খুঁজে পান। আরও জানা যায়, গোলাপিদেবীর দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে। বড় ছেলে কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকেন। বৃদ্ধার বাড়িতে এখন থাকেন তাঁর বছর পঁচিশের দৌহিত্র। তিনিই দিদিমার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আজ, বুধবার বিকেল চারটে নাগাদ গুয়াহাটি পৌঁছে নিজের বাড়ির পথে রওনা হবেন গোলাপিদেবী। তাঁকে এত দিন বাইরে ফেলে রাখার জন্য সকলকে যে বকাবকি করবেন, তা-ও রানাঘাটের হাসপাতালে বসে বলে গিয়েছেন তিনি। “এত দিন ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল না কেন?” অভিমান তাঁর গলায়।
আর রানাঘাটে মন খারাপ তাঁর ক’দিনের সঙ্গীদের। “ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল,” বললেন নার্স শীলা। আর কর্মী প্রদীপের কথায়, “মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় বার মাতৃবিয়োগ হল।” |