আনন্দplus
রোমে রংবাজি
মার্ক অ্যান্টনি আর জুলিয়াস সিজার দূর থেকে দেখছিলেন।
কলোসিয়ামের সামনে বছরের পর বছর প্রচুর ট্যুরিস্ট আসতে দেখেছেন তাঁরা। গ্ল্যাডিয়েটরদের নিয়ে ট্যুরিস্টদের উৎসাহের শেষ নেই। লাইন দিয়ে টিকিট কেটে তাঁরা ভিড় করেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে। দেখতে চান কী ভাবে সিংহ আর মানুষের যুদ্ধ হত এই অ্যাম্ফিথিয়েটারে। কিন্তু এ রকমটি কোনও দিন দেখেননি।
পড়ন্ত বেলায় পশ্চিম দিক থেকে যখন সূর্যের শেষ রশ্মি মায়াবী এক সৌন্দর্যে মুড়িয়ে ফেলেছে কলোসিয়ামকে, ঠিক তার সামনে এক ভারতীয় শ্যুটিং ইউনিট! ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। টেপে বেজে চলেছে বাংলা গান। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সুরে ‘কী করে বোঝাবো তোকে’... স্ক্র্যাচটা গেয়েছেন অরিজিৎ সিংহ। আর তার ছন্দে ‘বস’ খ্যাত পরিচালক বাবা যাদবের কোরিওগ্রাফিতে নেচে চলেছেন দুই নায়ক-নায়িকা। ক্যামেরার পিছনে শৈলেশ অবস্থী যিনি ‘হেরা ফেরি’ থেকে ‘চ্যালেঞ্জ ২’য়ের মতো ফিল্ম শু্যট করেছেন। এ রকম অভিজ্ঞতা তো এর আগে কোনও দিন হয়নি তাঁদের!

বাংলা ফিল্ম তো নয়ই, এমনকী রোমের অনেকেরই ধারণা যে, কোনও ভারতীয় ছবি এই রকম ভাবে শ্যুটিং করেনি। রাজা চন্দর ‘রংবাজ’ তাই একদমই আলাদা। সুরিন্দর ফিল্মসের কর্ণধার নিসপাল সিংহ রানে রীতিমত অনুমতি নিয়ে ভ্যাটিকান সিটির সামনে শ্যুটিং করলেন দেব আর কোয়েলের সঙ্গে।

ভ্যাটিকানের সামনে দেব-কোয়েল


কে এই মার্ক অ্যান্টনি আর জুলিয়াস সিজার
কলোসিয়ামের চত্বরে প্রচুর সুপুরুষ ইতালিয়ান গ্ল্যাডিয়েটরের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ান। যে সব মানুষ ইতিহাসের সাক্ষী হতে চান, তাঁদের কাছে এই ইতালিয়ান বহুরূপীরাও বেশ আকর্ষণীয়। পাঁচ ইউরো দিলে তাঁরা এসে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবেন। আপনাকেও পরিয়ে দেবেন গোলাপি ইতালিয়ান রোব। অথবা পাতার মুকুট। বাংলা সিনেমা সম্পর্কে না জানলেও এই দুই গ্ল্যাডিয়েটর মার্ক আর জুলিয়াস ইন্ডিয়া নামটা শুনেছেন। ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলেন, “বেশ অনেক ক্ষণ থেকে দেখছি শ্যুটিং হচ্ছে। কিন্তু কাছে গিয়ে যে দাঁড়িয়ে দেখব তার জো নেই। পুলিশ আমাদের এলাকা ভাগ করে দিয়েছে। ওর বাইরে আমরা গিয়ে দাঁড়াতে পারি না। আচ্ছা এই সিনেমাটার নাম কী?”


মার্ক অ্যান্টনি ও জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে দেব-কোয়েল
ভিনদেশি নামটা আড়ষ্ট জিভে উচ্চারণ করতে অসুবিধা হলেও, তিন-চার বার বলার পরে তা ঠিক হয়ে যায়। শ্যুটিংয়ের মধ্যে ছোট একটা ব্রেক। ট্রলি শিফ্ট করে অন্য দিকে বসবে। সেই ফাঁকে দেব-কোয়েলকে অনুরোধ করাতে তাঁরা আসেন গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে ছবি তুলতে। আর কোয়েলকে দেখে মার্ক অ্যান্টনির কী উত্তেজনা। যত্ন করে পরিয়ে দিলেন পাতার মুকুট। ভূয়সী প্রশংসা করলেন তাঁর সৌন্দর্যের। তার পর কোমর থেকে বের করলেন একটা ভোজালি। আর অবলীলাক্রমে দেবকে বললেন, “নিন, আমার গলায় চালিয়ে দিন!”

এ যেন এক মিনি বেঙ্গল
গ্ল্যাডিয়েটররা ইয়ার্কি করে ভোজালি চালাতে বলতে পারেন। তবে বাকি যাঁরা দেব-কোয়েলকে দেখার জন্য ভিড় করেছিলেন তাঁদের রিঅ্যাকশন একদম আলাদা। ভ্যাটিকান সিটির সামনে প্যারাম্বুলেটর চেপে ঘুরতে এসেছিল ছোট্ট ইদি। আট মাস বয়স। বাবার বাড়ি বাংলাদেশে। তবে আপাতত রোমের বাসিন্দা। দেব-কোয়েলের সঙ্গে ছবি তোলা মানে যেন তাঁদের জীবন সার্থক!
ইদি-র বাবার মতো বহু বাংলাদেশি ভ্যাটিকানের সামনে ভিড় জমান। কানে ভেসে আসে বাংলা ভাষা। দেব-কোয়েলের জনপ্রিয়তা এখানে তুঙ্গে। কেউ সানগ্লাস গিফ্ট করছেন। কেউ বা কাঠের টুকরো দিয়ে কোয়েলের নাম লিখে ট্রেনের বগি তৈরি করে উপহার দিলেন। নাম রাখলেন কোয়েল এক্সপ্রেস। কেউ আবার কানের কাছে ফোন গুঁজে দিয়ে বলছেন একটু যদি বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলেন।
রাজু প্রায় দেড় বছর হল রোমে আছেন। শ্যুটিং হচ্ছে শুনে কাজ বন্ধ করে সোজা লোকেশনে। বললেন, “মালিককে বলেছি জরুরি কাজ আছে। একদিনের মাইনে যাবে যাক। তবে এই শ্যুটিং দেখে যা পেলাম তা মাইনের থেকে অনেক বেশি। জানেন দেব-দার ডাক নাম রাজু। আমারও তাই।” কোয়েলের এক ফ্যান সইফুল তো বাড়ি গিয়ে পোশাক পালটে ফিরলেন যাতে তাঁকে বেশ ধোপদুরস্ত দেখতে লাগে। বললেন, “এখানে চশমা বিক্রি করি। ভ্যাটিকানের সামনে অন্তত তিনশো বাংলাদেশি হকার কাজ করেন। আমি তাঁদের মধ্যে একজন। আমাদের মধ্যে অনেকেই রোমে বসে চাইনিজ জিনিস বিক্রি করেন। এটাই বোধহয় বিশ্বায়নের ফল। প্রায় বারো লক্ষ টাকা খরচা করে এখানে এসেছি। তার পর আবার ভ্যাটিকানের সামনে ‘মামু’দের কী উৎপাত। মামু মানে পুলিশ। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ি নিয়ে এসে সব দোকান তুলে দেয়। এ সব অসুবিধা নিয়েই আমরা থাকি। বহু মাস বাড়ি যাওয়া হয়নি। ইন্টারনেটে দেব-কোয়েলদের ছবি দেখলে দেশের টানটা খুঁজে পাই। এখানে ‘রংবাজ’য়ের শ্যুটিং হচ্ছে শুনেই বুঝলাম এটা হচ্ছে সেই ছবি যেটার জন্যে ব্যাংককে এরোপ্লেন থেকে কোয়েল ‘আপা’ ঝাপ দিয়েছিলেন,” বলতে বলতেই ‘মামু’রা এলেন গর্ডিয়া ডি ফিন্যানজা লেখা গাড়ি করে। যে ক’টি হকার ক্যাস্টেল অ্যাঞ্জেলোর সামনে পসরা নিয়ে বসেছিল সবার জিনিসগুলো চাকার তলায় মাড়িয়ে দিয়ে গেল। সইফুলের সাঙ্গোপাঙ্গরা যে যা হাতে পেয়েছে তা নিয়ে ছুট!

ভ্যাটিকানের সামনে কোয়েল

নাগরদোলার সামনে

বাংলাদেশি ভক্তদের উপহার হাতে কোয়েল

ইচ্ছামতী কুয়োর সামনে কোয়েল

কেন এই রোমান হলিডে
ইতালিতে বাংলা ফিল্মের গানের শ্যুটিং নতুন নয়। ‘পাগলু থোড়াসা করলে রোম্যান্স’ হয়েছে এখানে। তবে রোমে এ ভাবে শ্যুটিং হয়নি। ভ্যাটিকানের সামনে ভিড় দেখে এক হকার তো জিজ্ঞেসই করে ফেললেন যে এটি কি কোনও ধার্মিক ছবি? তাঁকে বোঝানো হল যে ‘রংবাজ’ একেবারেই একটি প্রেমের গল্প যেখানে কোয়েল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, যিনি তাঁর বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ব্যাংককে বেড়াতে যাচ্ছেন, আর দেব হলেন তাঁদের ট্যুরিস্ট গাইড। ব্যাংকক চলে যাওয়ার আগে দেব একবার কোয়েলকে দেখতে এসে কল্পনায় এই গানের দৃশ্যগুলো ভাবতে থাকেন। ভ্যাটিকানের সামনে এই রকম ভাবে শ্যুটিং করতে পেরে রাজা অভিভূত। বলছেন, “শুনেছি ভ্যাটিকান সিটি একটা অন্য দেশ। ওখানকার কারেন্সি আলাদা। ওই চত্বরে শ্যুটিংয়ের অনুমতি নেই। তবে যা করেছি তা অন্য সব বিদেশে শ্যুট করা বাংলা ফিল্মের থেকে আলাদা হয়েছে।” রানে আরও জানান, “এর আগেও আমরা ভেবেছিলাম যে রোমে শ্যুট করব। যাঁরা ইতালি আসেন তাঁরাই রোমে যান। এখানকার ইতিহাস সবাইকে আকর্ষণ করে। কিন্তু কিছুতেই আমরা শ্যুটিংয়ের অনুমতি পাচ্ছিলাম না। এই বার আমাদের ইতালিয়ান শ্যুটিং কোঅর্ডিনেটর ইভানো আর মিকেলের চেষ্টায় আমরা অনুমতি পেয়েছি। যে ভাবে আমরা ভ্যাটিকানের কলোসিয়ামের শটটা নিয়েছি তা বাংলা ছবির দুনিয়ায় একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। গোটা ইতালি জুড়ে আমরা তিনটে গান শ্যুট করব।”

নাগরদোলা চাপা, ফিরে দেখা
বিদেশে শ্যুটিং করা সব সময় বেশ শক্ত। ন্যূনতম কলাকুশলী নিয়ে কাজ হয়। মেক আপ ভ্যান নেই। রোদে পুড়ে জলে ভিজে হেঁটে হেঁটে এক লোকেশন থেকে আরেক লোকেশনে যাওয়া, আর যতটা বেশি কাজ কম সময়ে করে নেওয়া যায় সেটাই চেষ্টা। কিন্তু এই পরিশ্রমের জন্য কারও কোনও আপত্তি নেই। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে হয়তো একটু মজা করা। প্রথম দিন শ্যুটিংয়ের মাঝে কোয়েল হঠাৎ গিয়ে এক নাগরদোলায় উঠে বসলেন, ভেবেছিলাম ওটা বোধহয় ফিল্মের শট। পরে জানা গেল তা একদমই নয়। নাগরদোলার মালিক নাকি কোয়েলের ফ্যান। একটা আস্ত ডিভিডি কালেকশন বানিয়ে ফেলেছেন কোয়েলের সিনেমার গান দিয়ে! কোয়েলকে তা দেখিয়েছেন। তার পর নিজেই বলেছেন নাগরদোলায় চাপার কথা। কোয়েলও এক পায়ে খাড়া। আর নাগরদোলায় উঠে নিজের ছবি তুলে দিতে অনুরোধ করলেন ডাকলেন প্রযোজক স্বামী রানেকে। “এর আগেও রোমে এসেছি। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে। হানিমুনে রানের সঙ্গে। ভ্যাটিকানের ভিতরে গিয়েছি। কলোসিয়ামের ভিতরেও গিয়েছি। গ্ল্যাডিয়েটরদের মধ্যে একটা নিয়ম ছিল, হয় গ্ল্যাডিয়েটর সিংহকে মারবে। না হলে সিংহের কাছে গ্ল্যাডিয়েটরকে মরতে হবে। আর সিংহটা লড়াইয়ে হেরে গেলে ওর মালিককে মেরে দেওয়া হত। তার অপরাধ হল, সে সিংহটাকে না খাইয়ে সে রকম ভাবে তৈরি করেনি যাতে সে লড়াইয়ে জিততে পারে। মোদ্দা কথা হল লড়াইয়ে যে কোনও একজন মানুষকে মরতেই হত। আর সেটা সবাই বসে গ্যালারি থেকে দেখত! এ রকম স্যাডিস্টিক জিনিসের মধ্যে মানুষ কী করে বিনোদন পেত ভেবে অদ্ভুত লাগে।”

কলোসিয়ামের সামনে

আমি দেব-এর বোন নই
দেবের অবশ্য এই শ্যুটিংয়ের অভিজ্ঞতা একটু আলাদা। এর আগে দু’বার বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে দু’টির সামনে শ্যুটিং করেছেন। কলোসিয়ামে শ্যুটিং করা মানে আরও একটা আশ্চর্যের সামনে শ্যুটিং করা। তবে এই বার দেবের বিদেশ সফর আরও একটু স্পেশাল। তার কারণ বোন দীপালিকে রোম দেখানোটা ছিল তাঁর রাখির উপহার। শুধু ঘোরানো নয়, জুতো থেকে জ্যাকেট সব কিছু কিনে দিলেন বোনকে। দেব রোম থেকে আবার চলে যাবেন সোজা দক্ষিণ আফ্রিকা। ওখানে ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শ্যুটিং। কিন্তু মুম্বইয়ের বাড়িতে গণেশ পুজো বলে দীপালির দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়া হবে না দেবের সঙ্গে।
ইতালিতে একটা মজার কাণ্ড হল শ্যুটিংয়ের সময়! দেবকে নাগালের মধ্যে না পেয়ে তাঁর ফ্যানেরা সঙ্গে সঙ্গে ছেঁকে ধরছিলেন দীপালিকে। কত রকমের প্রশ্ন! দেব কবে বাংলাদেশ যাবেন? শেষ বার কবে গিয়েছিলেন? শেষে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে দীপালি ঠিক করলেন যে তিনি তাঁর পরিচয়টাই গোপন রাখবেন। শুধু বললেন তিনি মুম্বইতে পড়াশোনা করেন। ইউনিটের সঙ্গে এসেছেন। দেবের সম্পর্কে কিছু জানেন না!
শুধু যে বাংলাদেশি ফ্যান, তা নয়। হিস্টেরিয়ামিটারে বিদেশি মহিলারাও কম যাননি। কাজাখস্তানের যুবতী থেকে শুরু করে চাইনিজ ঠাকুমা সবার চাই এক টুকরো দেব। রোমের বিখ্যাত স্প্যানিশ স্টেপস্-এর সামনে এক বৃদ্ধা নিজের নাতনিকে নিয়ে দেবের সঙ্গে ছবি তুললেন। ‘উইশিং ওয়েল’-এর সামনে এক বিদেশিনি তো নিজের হাত থেকে খুলে দেবকে পরালেন ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড। ইচ্ছামতী কুয়োতে পয়সা ছুড়ে কী চাইলেন তা না বললেও ঠোঁটে লেগেছিল প্রশান্তির হাসি।
তবে সব দেখে একটা কথা মনে হল যে স্থান-বয়স-পাত্র সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল টলিউডের রংবাজি।


ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেব

ভ্যাটিকানের সামনে বোন দীপালির সঙ্গে দেব

ছবি: মিকেলে সারাগোনি



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.