১২ কিলোমিটার উঁচু মেঘ ভেঙে ভাদ্রে কালবৈশাখী
রদুপুরে জ্বলে উঠল রাস্তার আলো। কারণ, চার দিক অন্ধকার। ঘন কালো মেঘ ছাতার মতো গোটা আকাশটাকে ঢেকে ফেলেছে। কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় হঠাৎ সন্ধে! অথচ ঘড়ির কাঁটা বলছে, দুপুর আড়াইটে!
ভরা ভাদ্রে এ যেন আকস্মিক কালবৈশাখী! সে রকম জোরালো ঝড় ছিল না ঠিকই। কিন্তু মুষলধার বৃষ্টি, সঙ্গে বাজ আর বিদ্যুৎ। আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, ১২ কিলোমিটার উঁচু জলভরা মেঘ এ দিন ভেঙেছে কলকাতার উত্তর-পূর্ব
আকাশে। তবে ওঁদের মতে মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি বা ‘ক্লাউডবার্স্ট’ বলতে যা বোঝায়, সংজ্ঞার দিক থেকে এ দিনের মেঘ ভাঙাকে সেই নামে ডাকা যাবে না। কিন্তু এ দিন যে প্রক্রিয়ায় মেঘ জমেছে এবং ভেঙে পড়েছে, তেমন ঘটনাও সচরাচর ঘটে না বলে জানান তাঁরা।
কী রকম? আবহবিদদের বক্তব্য, এ দিনের মেঘ-বৃষ্টি বর্ষার অতি পরিচিত ঘূর্ণাবর্ত ও নিম্নচাপের বৃষ্টি ছিল না। গত সপ্তাহেই নিম্নচাপের টানা বৃষ্টিতে ভুগেছেন কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। আলিপুর আবহাওয়া দফতর সোমবার সকালে জানিয়েছিল, বাংলাদেশ ও সন্নিহিত বঙ্গোপসাগরে তৈরি হচ্ছে একটি ঘূর্ণাবর্ত। যার ফলে ফের ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে গোটা দক্ষিণবঙ্গে। কিন্তু দুপুরে যেটা ঘটল, তার আগাম আঁচ ছিল না হাওয়া অফিসের কাছে।
বেলা ১২টাতেও শহরের আকাশে ছিল চাঁদিফাটা রোদ। শুধু পশ্চিম কোণে এক টুকরো মেঘ দেখা যাচ্ছিল। অথচ ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যে দৈত্যাকার কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে ফেলল। যেমন ঘটে কালবৈশাখীর বেলায়।
সাধারণত চৈত্র-বৈশাখের বিকেলে যে রকম খাড়া বা উল্লম্ব মেঘ তৈরি হয়, এ দিনও ঠিক সেই রকম মেঘ তৈরি হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। কিন্তু একই সঙ্গে এ দিনের ঘটনার সঙ্গে কালবৈশাখীর বড় তফাৎও রয়েছে। আলিপুরের কর্তারা জানাচ্ছেন, কালবৈশাখী তৈরি হওয়ার গোটা প্রক্রিয়াটাই ঘটে স্থলভূমিতে। সেখানে বাতাস গরম হয়ে উপরে উঠে যায়। উপরে গিয়ে ঠান্ডা বাতাসের সংস্পর্শে তৈরি হয় উল্লম্ব মেঘ। সেই মেঘ যেখানে মাটির কাছাকাছি চলে আসে, তখনই তৈরি হয় কালবৈশাখী। কিন্তু সোমবার দুপুরের উল্লম্ব মেঘ তৈরি হয়েছে সমুদ্রে। হাওয়ার গতি এ দিন ছিল সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, “বাংলাদেশ ও সন্নিহিত বঙ্গোপসাগরের উপরে এ দিন তৈরি হয়েছিল একটি ঘূর্ণাবর্ত। সেই ঘূর্ণাবর্তের প্রবল টানে এ দিন দুপুরে কলকাতা ও সন্নিহিত এলাকার বায়ুপ্রবাহের গতি উল্টে যায়।’’ বছরের এই সময়টায় সাধারণত জলীয় বাষ্প-ভরা বাতাস সমুদ্র থেকে স্থলভূমির দিকে আসে। কিন্তু এ দিন দুপুরে বায়ুপ্রবাহের গতিমুখ বদলে যাওয়ায় স্থলভূমির বাতাস এগোতে থাকে সমুদ্রের দিকে।
তিন দিন বৃষ্টি না থাকায় দক্ষিণবঙ্গের সর্বত্র রোদের তাপ ছিল প্রচণ্ড। রবিবার কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। স্থলভূমির বাতাস ছিল গরম এবং অপেক্ষাকৃত শুকনো। গোকুলবাবু বলেন, শুকনো এবং গরম বাতাস ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রে পৌঁছে সমুদ্রের ঠান্ডা, ভিজে বাতাসের মুখোমুখি পড়ে যায়। দুয়ে মিলে তৈরি হতে শুরু করে উল্লম্ব মেঘ। ঘূর্ণি বাতাসে উল্লম্ব মেঘ লম্বায় বাড়তে থাকে। এক সময় ১২ কিলোমিটার উঁচু হয়ে কলকাতা ও সন্নিহিত এলাকার আকাশকে প্রায় গ্রাস করে নেয় এই মেঘ। আবহবিদেরা বুঝে যান বিপদ ঘনাচ্ছে। কিন্তু সতর্ক করার আগেই ভেঙে পড়ে জলভরা মেঘ। গত ১৫ জুন উত্তরাখণ্ডে পাহাড়ের গায়ে এ রকমই মেঘপুঞ্জ ভেঙে কেদার ও সংলগ্ন এলাকা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। হড়পা বানে মন্দির, জনপদ সব খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, লাদাখে প্রায়ই এমন মেঘ-ভাঙা বৃষ্টির দেখা মেলে। কলকাতায় সোমবার যে মেঘ ভাঙল, তাকে অবশ্য সরাসরি মেঘ-ভাঙা বৃষ্টি বলতে রাজি নন আবহবিদেরা। কারণ, ‘ক্লাউডবার্স্ট’ বা মেঘ-ভাঙা বৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লম্ব মেঘের দৈর্ঘ্য আরও অনেক বেশি হয়। জলধারণ ক্ষমতাও থাকে বেশি। ওই মেঘপুঞ্জ তৈরি হওয়ার প্রাকৃতিক নিয়মও ভিন্ন। ওই মেঘ সমতল থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠে। যত ওঠে তত লম্বা হয়। একটা সময় যখন আর জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে না, তখন ভেঙে পড়ে।
এ দিন অকাল কালবৈশাখীর তাণ্ডবও অবশ্য কম ছিল না। কালবৈশাখীর মতোই এ দিনের বৃষ্টিতেও বাজ পড়েছে প্রচুর। আবহবিদদের মতে, উল্লম্ব মেঘ ভাঙার সময়েই সাধারণত বাজ পড়ে। কেন? মেঘের মধ্যে ইলেকট্রনের তারতম্যে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়। সেই উত্তাপে মেঘের মধ্যে থাকা বিভিন্ন গ্যাসের পুঞ্জ ফেটে পড়তে থাকে বলে অনেকের মত। এ দিনের বজ্রপাতে রাজ্যে তিন শিশু-সহ ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত তেইশ জন। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি আর ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়া। পৌনে এক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছে সল্টলেক-নিউ টাউন। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের প্রাথমিক হিসেব, ওই সময়ের মধ্যে দমদমে প্রায় ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় গাছ পড়ে যানবাহন চলাচল বিপর্যস্ত।
বৃষ্টির পরেও ঘূর্ণাবর্তের শক্তি অবশ্য কমেনি। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস, দক্ষিণবঙ্গে আজ, মঙ্গলবারও ভারী বৃষ্টি হবে। ঘূর্ণাবর্তের আশপাশে বায়ুপ্রবাহের যা অবস্থা, তাতে সেটা নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আর তাতেই উদ্বেগের মেঘও ঘনাতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহের নিম্নচাপ দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টির ঘাটতি পুরোপুরি মিটিয়ে দিয়েছিল। তিন দিনের বৃষ্টিতে রাজ্যের সব জলাধার পরিপূর্ণ। নদী-নালা টইটম্বুর। এখন ফের ভারী বৃষ্টি হলে, তা বন্যা ঠেকাতে পারবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় সেচ দফতর। কৃষি দফতরও ভারী বৃষ্টি চাইছে না। রাজ্যের কৃষি আধিকারিকের মন্তব্য, “এখন অতিবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হতে পারে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.