আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা বিলেতের সবচেয়ে পুরনো মাঠ। এই মাঠ অ্যাসেজের জন্ম দেখেছে। এই মাঠেই স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্ট। এই কেনিংটন ওভালই দেখেছে ইংল্যান্ডের ৯০৩ রানের ঐতিহাসিক ইনিংস, মাইকেল হোল্ডিংয়ের ১৪ উইকেট শিকারের মতো ক্রিকেট-ইতিহাসের আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন।
এ বার সেই ওভালই এমন ঘটনার সাক্ষী, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে যাকে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক মুহূর্ত বলা হবে কি না, তাই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে।
বাইশ গজে গণ-প্রস্রাব! অ্যাসেজ জয় উদযাপন করতে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা এই পন্থাই নিয়েছেন বলে অভিযোগ!
অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েক জন সাংবাদিক রবিবার রাতে ঘটনাটা দেখেছেন বলে দাবি। ওভালের পিচ প্রস্তুতকারকরা এবং মাঠ পরিষ্কার করতে আসা অনেকেও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। |
‘জেন্টলম্যান’স গেম’-এর এমন চেহারা আগে কখনও দেখেনি দুনিয়া। কী ভাবে ব্যাখ্যা হবে এর? ক্রিকেট-লিখিয়েদের একাংশের মতে, বেনজির অর্থ ও গ্ল্যামারের আমদানি যে ক্রিকেটের কৌলীন্য ও আভিজাত্যকেই ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, রবিবার রাতের ঘটনা তারই প্রমাণ। আইপিএল-জমানায় এখন চটজলদি টাকা কামানোর রাস্তা আরও চওড়া হয়েছে। আগ্রাসী বিনোদনের থাবায় বলি হচ্ছে ক্রিকেটের নিজস্ব চরিত্রটাই। আবার অন্য একটি দলের মতে, আভিজাত্যের মাপকাঠিতে ক্রিকেটের সঙ্গে ফুটবলের যে তফাৎ ছিল, সেটা এখন অনেকাংশে উধাও। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড বা আর্সেনালের মতো দল না হয় বাদই দেওয়া গেল! প্রিমিয়ার লিগে খেলা বহু ফুটবলারই এখন যে পরিমাণ টাকা রোজগার করেন, বিলিতি ক্রিকেটারদের অনেকে তার চেয়ে খানিক পিছিয়েই আছেন। বিত্ত এবং সামাজিক মর্যাদায় ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকা ফুটবলাররা বরং এখন সম্ভ্রান্ত আচার-আচরণের দিকে ঝুঁকছেন। ক্রিকেটাররা হাঁটছেন ঠিক তার উল্টো দিকে।
এগারো বছর আগে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়ের পর লর্ডসের ঐতিহাসিক ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গা থেকে টি-শার্ট খুলে উড়িয়েছিলেন বলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কড়া নিন্দা করেছিল ব্রিটিশ মিডিয়া। এ বার কিন্তু তারা অনেকটাই নীরব। এ দিন সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। মন্তব্য করেনি ইসিবি বা আইসিসি-ও। ইসিবি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিউ মরিস বছরের শেষে ফিরতি অ্যাসেজের পর দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে ওভালের ঘটনার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের সম্পর্ক নেই বলে জানা গিয়েছে। |
ইংল্যান্ডের ক্রীড়ামন্ত্রী হিউ রবার্টসন অবশ্য বলেছেন, “ঘটনাটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে সেটা অবশ্যই ভাল হয়নি।” ইসিবি-কে তদন্ত করার জন্য বলেছেন তিনি। চাপ এসেছে ওভাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও। স্টেডিয়ামের কর্মীরা তাঁদের বক্তব্য ইসিবি-কে জানিয়েছেন। পিচ কিউরেটর ক্যাম সাদারল্যান্ড গোটা ব্যাপারটা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। সারে কাউন্টি-র চিফ এগজিকিউটিভ রিচার্ড গউল্ডের প্রতিক্রিয়া, “আমরা অত্যন্ত মর্মাহত।”
ঠিক কী ঘটেছিল রবিবার রাতে? সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ শ্যাম্পেন স্নান, হইহুল্লোড়, বিয়ার পান, একে অপরকে অভিনন্দনের পর্ব এক প্রস্ত মিটেছিল। তার পর ব্রিটিশ ক্রিকেটাররা ঠিক করেন, যে উইকেটে তাঁরা সিরিজ জিতলেন, মাঠ ছাড়ার আগে সেই উইকেটে বসে বিয়ার পান করবেন। মাঠের মাঝখানের অংশটা তখন চার দিকের তুলনায় বেশ অন্ধকার। গ্রাউন্ডসম্যানদের কাজ তখনও শেষ হয়নি। বিয়ার-পান চুকে যাওয়ার পর হঠাৎই উল্লাসে মেতে ওঠেন কেভিন পিটারসেনরা। তিনি, স্টুয়ার্ট ব্রড এবং জিমি অ্যান্ডারসন উইকেটের ওপর প্রস্রাব করতে শুরু করেন। তাঁদের রীতিমতো উৎসাহ দেন বাকিরা। মাঠকর্মীরা এমন বেনজির দৃশ্য দেখে অবাক। এতটাই আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটনাটা ঘটে যে, বাধা দেওয়ার সুযোগই পাননি তাঁরা।
কয়েক জন অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক তখনও প্রেস বক্সে বসে কাজ করছিলেন। তাঁরা পুরো ঘটনাটা দেখতে পান বলে দাবি সে দেশের প্রখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে ম্যালকম কন-এর। হেরাল্ড সান-এ তিনি লিখেছেন, “ঘটনাটা প্রেস বক্সের ওভারফ্লো এরিয়ার বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে।” মজা করে কন লিখেছেন, “অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের আটকানোর জন্য তৈরি আদ্যন্ত শুকনো উইকেটে এটাই একমাত্র আর্দ্রতা প্রয়োগের ঘটনা।” অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার টম মুডি-র মন্তব্য, “১৯৯৯-এ বিশ্বকাপ জয়ের সেলিব্রেশন আমরা লর্ডসের মাঝখানে করেছিলাম বটে। কিন্তু সেখানে প্রস্রাবের কথা ভাবিনি। ইংল্যান্ডও বোধহয় উইকেট নিয়ে খুশিই ছিল।” সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ক্রিস ব্যারেট লিখেছেন, “অ্যাসেজ শেষ হল ‘ডবল স্প্রে’ দিয়ে। প্রথমটা, মাইকেল ক্লার্কের প্রতি ওভালের দর্শকদের (কটু মন্তব্য)। শেষেরটা, পিচের উপর ইংরেজ ক্রিকেটারদের।” |
উন্মত্ততা এখানেই থামেনি। কুক-প্রায়র-ব্রডরা এর পর স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় বেরিয়ে পাবলিক বাস থামানোরও চেষ্টা করেন, তাতে চড়ে হোটেলে ফিরবেন বলে। তবে এই ঘটনায় ইংল্যান্ডের স্পিনার মন্টি পানেসর কোনও ভাবে জড়িত ছিলেন বলে খবর নেই। পানেসর কয়েক দিন আগে এক পানশালায় দুই নিরাপত্তারক্ষীর গায়ে প্রস্রাব করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। সেই কাণ্ডই পিটারসেনদের এই কাজে উদ্বুদ্ধ করল কি না, তার ব্যাখ্যাও মেলেনি। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন মাইকেল ভন টুইটারে লিখেছেন, “মনে হচ্ছে পরের বছর ভারতীয় দলের সফরের জন্য এখন থেকেই উইকেটের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ইংল্যান্ড।”
তবে এই বিতর্কিত ঘটনার কোনও ছবি অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার কোনও কাগজ, ওয়েবসাইটে বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পাওয়া যায়নি। কোনও ভিডিও ফুটেজও মেলেনি। তবে সেই রাতে মাঠের মাঝখানে গোল হয়ে বসে ইংরেজ ক্রিকেটাররা যে বিয়ার পান করেছিলেন, সেই ছবি টুইটারে পোস্ট করেছেন ম্যাট প্রায়র। এমনকী, লন্ডনের রাস্তায় নেমে যে ক্যাপ্টেন কুক ও প্রায়র ডবল-ডেকার বাস থামানোর চেষ্টা করছিলেন, সেই ছবি পোস্ট করেছেন ব্রড। কিন্তু উইকেটে প্রস্রাবের ছবির কোনও হদিশ নেই।
ব্রিটিশ মিডিয়ার একাংশ তাই প্রশ্ন তুলেছে, অ্যাসেজে হারের পরে এটা অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার পাল্টা আক্রমণের একটা কৌশল নয় তো? আইরিশ টাইমস-এর ক্রিকেট লিখিয়ে এমেট রায়র্ডান মজাদার টুইট করেছেন, “হটস্পটে তো এর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ বার মনে হয় আইসিসি-কে ওয়েটস্পটের ব্যবস্থাও করতে হবে।”
|
গৌরবের ওভাল, কলঙ্কের ওভাল |
রবিবার ব্র্যাডম্যানের শেষ টেস্টের স্মৃতি জড়ানো কেনিংটন ওভালে অ্যাসেজ শেষ হওয়ার পরে মাঠেই বিয়ার পার্টি করেন কুকরা। ম্যাট প্রায়র যে ছবি টুইট করে লিখেছেন, “অ্যাসেজের সেরা মুহূর্ত”। এর পরেই সেই কুখ্যাত ও বিতর্কিত ঘটনাটি ঘটান তাঁরা। যার কার্টুন সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে। এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন ইংরেজ ক্রিকেটাররা যে, স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে কুক, ম্যাট প্রায়র ও স্টুয়ার্ট ব্রড পাবলিক বাস ধরে টিম হোটেলে ফেরার পরিকল্পনা করেছিলেন। ব্রডের টুইট করা ছবিতে কুক-প্রায়রদের বাস থামানোর প্রচেষ্টা। |
|
ক্রিকেট-কেচ্ছার পাঁচকাহন |
মিয়াঁদাদকে লিলির লাথি: ১৯৮১ সালে পাকিস্তানের অস্ট্রেলিয়া সফরের প্রথম টেস্টে লিলির বল স্কোয়ার লেগে ঠেলে মিয়াঁদাদ রান নেওয়ার সময় ইচ্ছে করে বাধা দেন অজি পেসার। মিয়াঁদাদের অভিযোগ, তাঁকে লাথিও মেরেছেন লিলি। আর লিলির পাল্টা অভিযোগ, মিয়াঁদাদ তাঁকে অকথ্য গালাগাল করেছেন।
ডোপিং কেলেঙ্কারি: রক্তে নিষিদ্ধ ‘ডাইইউরেটিক’ মেলায় ২০০৩ বিশ্বকাপ থেকে নির্বাসিত শেন ওয়ার্ন। এক বছর জন্য নির্বাসিত সব ধরনের ক্রিকেট থেকে।
গড়াপেটা কাণ্ডে ক্রোনিয়ের নির্বাসন: ২০০০-এ দিল্লি পুলিশের প্রকাশিত টেপে বুকিদের সঙ্গে ম্যাচ গড়াপেটার নিয়ে হ্যান্সি ক্রোনিয়ের কথোপকথন ফাঁস। কিংস কমিশনের তদন্তের পর দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক সারা জীবনের জন্য নির্বাসিত হন।
আন্ডারআর্ম বোলিং: ১৯৮১ অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বেনসন-হেজেস সিরিজের তৃতীয় ম্যাচ। সিরিজের ফল ১-১। শেষ বলে ম্যাচ টাই করতে ৬ চাই কিউয়িদের। ভাই ট্রেভরকে দিয়ে আন্ডারআর্ম বোলিং করিয়ে ম্যাচ জিতলেও ধিকৃত অজি অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল।
স্পট ফিক্সিং: ২০১০-এ ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডের স্টিং অপারেশনে ধরা পড়লেন পাক অধিনায়ক সলমন বাট, মহম্মদ আসিফ, মহম্মদ আমের। |
|
|
|