স্পঞ্জ আয়রনের দূষণ বন্ধ হয়নি, মানছেন মন্ত্রীও
রকারের তরফে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বিধানসভার অধিবেশন বসলেই ঘুরেফিরে প্রসঙ্গটি ওঠে। তবু বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলার স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলি থেকে ছড়িয়ে পড়া দূষণ রেহাই দিচ্ছে না কাউকেই! এই কারখানাগুলি যে শুধু বাতাসে বা আশেপাশের মাটিতে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে তা-ই নয়, বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল তুলে নিয়ে অন্য রকম বিপদও ডেকে আনছে। অথচ তার পরেও কোনও সরকারই এদের বিরুদ্ধে সে ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। রুটি-রুজির দোহাই দিয়ে পরিস্থিতির কাছে কার্যত নতি স্বীকার করেছেন প্রশাসনের কর্তারা।
সোমবার বিধানসভার অধিবেশন বসলে স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণের প্রসঙ্গটি ফের তোলেন গলসির সিপিএম বিধায়ক সুনীল মণ্ডল। প্রশাসনের কাছে তাঁর আবেদন, “কিছু করুন। দুর্গাপুরে স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলোর দূষণে আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।” সরকারপক্ষের কাছে সুনীলবাবু যখন এই আবেদন জানাচ্ছেন, তখন সভার বাইরে ছিলেন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী ও বর্ধমানের সিপিএম নেতা নিরুপম সেন। বাম আমলে স্পঞ্জ আয়রন কারখানার বাড়বাড়ন্তের জন্য তাঁর দিকেও অভিযোগের আঙুল তোলেন বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। এ দিন প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রীও স্বীকার করেন, “এ সব কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের নজরদারি চালিয়েও লাভ হয়নি। দূষণ বেড়েই গিয়েছে।” আর রাজ্যের বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের স্বীকারোক্তি, তাঁর দফতর নিয়ন্ত্রণ জারি রেখে মাত্র ২০%-র মতো দূষণ কমাতে পেরেছে।
দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বিকাশ মশানের তোলা ছবি।
২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বাঁকুড়ায় গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবেন। ক্ষমতায় আসার দু’মাসের মধ্যে সুদর্শনবাবু রাজ্যের সব ক’টি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মালিকদের নিয়ে বৈঠকও করেন। ২০০০ সাল থেকে এই কারখানাগুলি কাজ করার অনুমোদন পাওয়ার পর সেই প্রথম বার কারখানাগুলির মালিকরা সরকারি দফতরে হাজির হয়ে মন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই দিনের পরে আশায় বুক বেঁধেছিলেন স্থানীয় মানুষ। কিন্তু কোথায় কী?
এ দিন বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিবেশমন্ত্রীই জানান, ২০১২-২০১৩ সালে মোট ৩৭টি কারখানার কাজকর্ম নিয়ে শুনানির পরে ১১টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরও ২৬টি কারখানাকে জরিমানা করা হয়েছে। মন্ত্রীর আরও দাবি, পরিবেশ দফতর থেকে কারখানাগুলিতে দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানো হয়েছে। সেগুলি ‘মনিটর’ করা হচ্ছে। ফলে গত দু’বছরে ২০% দূষণ কমেছে।
মন্ত্রীর এই দাবি কিন্তু মানতে নারাজ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন আইনি অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “চাপে পড়ে কারখানাগুলো ইলেকট্রো স্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ইএসপি) যন্ত্র লাগিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলো চলে না। এবং যন্ত্রের উপর নজরদারি চালানোর মতো পরিকাঠামোও পরিবেশ দফতরের নেই।” এ দিন বিধানসভায় সিপিএমের ওই বিধায়কেরও অভিযোগ ছিল, যন্ত্র থাকলেও সেগুলি বন্ধ করে রাখেন কারখানা কর্তৃপক্ষ।
কুড়ি শতাংশ দূষণ কমা নিয়ে মন্ত্রীর দাবি মানতে নারাজ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নাগরিক মঞ্চ-র সম্পাদক নব দত্তও। তাঁর অভিযোগ, “তথ্যের অধিকার আইনে জানা গিয়েছে, স্পঞ্জ আয়রন শিল্প থেকে নির্গত দূষিত তরল বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের কোনও উপায় নেই। সেখানে লোহা, কয়লা ও ডলোমাইটের যে গুঁড়ো বর্জ্য ডাঁই করা পড়ে থাকে, তা আশপাশের জনপদ, চাষের জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের স্বাস্থ্য, ফসল সব কিছুর উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এই বর্জ্য।”
শুধু বর্জ্য নয়, এই শিল্পে জলের ব্যবহার নিয়েও সরকারি মহলে আতঙ্ক রয়েছে। রাজ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের মতে, স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় ১ টন উৎপাদনের জন্য ৩ টন জল প্রয়োজন হয়। এই জল আসার কথা বৃষ্টি ও পুকুর কেটে। কিন্তু কী ভাবে জল নেওয়া হয়? বাঁকুড়ার বড়জোড়ার একটি কারখানার উল্লেখ করে রাজ্য জলসম্পদ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “২০০৯ সালে এদের আবেদন পেয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখি অনুমতি পাওয়ার আগেই তারা উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে! কংসাবতী নদীর তলায় মাটি খুঁড়ে সাবমার্সিবল পাম্প ঢুকিয়ে প্রকল্পের জন্য জল নেওয়া হচ্ছে! তখন কিছু করার ছিল না। কারণ, ওই দিনই জেলাশাসকের সঙ্গে বৈঠকে ওই সংস্থাকে অনুমোদন দেওয়া হয়।”
স্পঞ্জ আয়রন কারখানার দূষণ নিয়ে সকলেই উদ্বিগ্ন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মানলে প্রায় সব ক’টি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। কারখানা মালিকদের বৈঠকে ডেকে পরিবেশ মন্ত্রী যে ১১ দফা নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা-ও মানা হয়নি। কিন্তু কেন কোনও সরকারই এই সব কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না? প্রাক্তন মন্ত্রী নিরুপমবাবুর ব্যাখ্যা, “হাজার হাজার মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ করা মুশকিল।” সরকারের এক পদস্থ কর্তার বক্তব্য, এই কারণেই এ নিয়ে প্রতিশ্রুতি থাকবে, জনপ্রতিনিধিদের আলোচনাও থাকবে। কিন্তু স্পঞ্জ আয়রন থেকে দূষণের ট্রাডিশন চলবেই।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.