|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
অ্যাসিড ও মেয়েরা: কিছু কি বদলাবে
৩৬ ঘণ্টায় আসামি গ্রেফতার। চার মাসে প্রথম পর্বের বিচার শেষ।
তামিলনাড়ুতে
অ্যাসিড হানার এক মামলায় এমনটাই ঘটেছে। আশা জাগে।
বাংলাদেশ তো অনেকটাই পেরেছে, আমরাই বা নয় কেন?
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
১৪ নভেম্বর ২০১২। কারাইকল, তামিলনাড়ু। বাবার সঙ্গে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিনোদিনী। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দীপাবলিতে বাড়ি এসেছিলেন। ছুটি শেষ। চেন্নাই ফিরবেন। আচমকা তাঁর মুখে অ্যাসিড ছুড়লেন জনৈক সুরেশ। বিনোদিনীর অপরাধ: তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেননি। মুখের চামড়া গলে যায়, চোখ দুটি চলে যায়, মৃত্যুর সঙ্গে তিন মাস লড়ে গত ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে মারা যান তেইশ বছরের মেয়েটি।
৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সুরেশকে ধরে পুলিশ। ২০ অগস্ট, শুনানি শুরুর চার মাসের মধ্যে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেন অতিরিক্ত দায়রা বিচারক এন বৈদ্যনাথন। এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণও ধার্য হল। এ দেশে কী করে এত দ্রুত বিচার সম্ভব হল? হয়তো ১৬ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের জারি করা নির্দেশিকার পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে এর উপর। অ্যাসিড হামলাকারীদের জামিনের পথ আটকানো হয় নির্দেশিকায়, অ্যাসিড বিক্রির নিয়ম কড়া করার কথা বলা হয়, অ্যাসিড-জখমদের ক্ষতিপূরণ করা হয় তিন লক্ষ টাকা। রাজ্যগুলিকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে অ্যাসিড হামলা প্রতিরোধে গাইডলাইন তৈরি করে জমা দিতে বলেছিল শীর্ষ আদালত।
হয়তো এটুকুর জন্যই কপালে হাত ছোঁয়াবেন ওঁরা। হাসিনা, মাবিয়া, অনু, সোনালি, লক্ষ্মী। মুখ-গলা-মাথা-হাত অ্যাসিডে ঝলসে হাড় বেরিয়ে গিয়েছে, দেখে মানুষ আঁতকে ওঠে, অধিকাংশের চোখের দৃষ্টি বিনষ্ট। কিন্তু সত্যিই কতটা ভরসা পেয়েছেন দেহে মনে ঝলসে যাওয়া এই মেয়েরা? সম্প্রতি ওঁদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয়েছিল এই বিষয়ে।
দিল্লির মেয়ে লক্ষ্মী। তাঁর আবেদনের ভিত্তিতেই গত ১৬ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারকে ভর্ৎসনা করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর এম লোধা ও ইব্রাহিম কালিফুল্লা-র নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ অ্যাসিড হামলা সংক্রান্ত নির্দেশিকাটি জারি করে। ২০০৫ সালে খান মার্কেটে বইয়ের দোকানে কাজ করতেন লক্ষ্মী। তখন ১৫। বিয়ের প্রস্তাব দেয় ৩২ বছরের এক ব্যক্তি। প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে ভরা বাজারে লক্ষ্মীর মুখে অ্যাসিড ছোড়ে। গোটা মুখের মাংস গলে গিয়েছিল। চার বছরে মুখে সাতটা সার্জারি হয়। আরও অন্তত ১০টা দরকার ছিল। টাকায় কুলোয়নি, বসতবাড়িটাও বন্ধক রাখা হয়ে গিয়েছে তত দিনে। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
লক্ষ্মীর বক্তব্য, “যতগুলো সার্জারি আমাদের করতে হয় তাতে তিন লক্ষ টাকায় কিচ্ছু হবে না। আর আমরা যারা ১৬ জুলাইয়ের আগে আক্রান্ত হয়েছি এবং এখনও চিকিৎসা দরকার, তাদের জন্য তো কোনও ক্ষতিপূরণই ঘোষণা হয়নি! যাঁরা ১৬ জুলাইয়ের পরেও অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন বা হবেন তাঁরাও আগামী পনেরো বছরে পুরো টাকাটা পাবেন না। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন।”
সোনালি মুখোপাধ্যায় ধানবাদের প্রবাসী বাঙালি, এখন দিল্লির বাসিন্দা। ২০০৩ সাল। অষ্টাদশী সোনালি বাড়ির লোকের সঙ্গে ছাদে ঘুমোচ্ছিলেন। মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেয় প্রতিবেশী তিন যুবক। মুখের হাড়গোড় বেরিয়ে যায়। অন্ধ হয়ে যান। অপরাধীদের ন’বছরের জেল হয়েছিল। দু’বছরের মাথায় তাঁরা হাইকোর্টে জামিন পেয়ে যান। দশ বছরে ২৮টা অস্ত্রোপচার, চিকিৎসায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ। বাড়ি, জমি, জমানো টাকা সব শেষ তাঁর পরিবারের। সোনালির প্রশ্ন, নিম্ন আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও উচ্চ আদালতে বহাল থাকবে তো?
গত দশ মাস মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল হাসপাতালে ভর্তি বনগাঁর মেয়ে ২৮ বছরের মাবিয়া মণ্ডল। ২০০৪ থেকে মুম্বইয়ে রান্নার কাজ করতেন মাবিয়া। বিয়ে হয়েছিল। চার বছরের মেয়ে আছে। অভিযোগ, পারিবারিক অশান্তির জেরে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ঘুমন্ত মাবিয়ার মুখে অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে পালান তাঁর স্বামী। মুখ, গলা, বুক, দলা পাকিয়ে গেছে। হাসপাতালের শয্যা থেকে দৃষ্টিহারা মাবিয়া ফোনে বললেন, “দোষী লোকটার কঠিনতম শাস্তি চাই আমি। যাতে কেউ এই রকম হামলার প্ল্যান করলেও শাস্তির কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন।” একই কথা বেঙ্গালুরুর আক্রান্ত হাসিনা হোসেনের। ১৯৯৯ সালে অ্যাসিড হামলায় ক্ষতবিক্ষত, অন্ধ হয়ে যাওয়া হাসিনার মতে, “আমাদের যা হয়েছে, তাতে যাবজ্জীবন কোনও শাস্তিই নয়।”
বিচার ও শাস্তি হল একটা দিক। অন্য দিকটা অপরাধ নিবারণের। তারই বা ভরসা কতটুকু? নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী আঠারোর চেয়ে কমবয়সিকে অ্যাসিড বিক্রি না-করা নিশ্চিত করবে কে? সোনার গয়নার কারখানায়, গাড়ি, বাইক বা ইনভার্টারের ব্যাটারি থেকেও অ্যাসিড পাওয়া যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার সব ক’টি দেশেই অ্যাসিড নারীর উপর হিংসার বড় হাতিয়ার। কারণ এখানে তা সস্তা ও সুলভ। এর মধ্যে বাংলাদেশ কিন্তু অ্যাসিড হামলা নিয়ন্ত্রণে দারুণ সফল। ২০০১ পর্যন্ত বছরে অন্তত দু’হাজার অ্যাসিড হামলা হত। ২০০২ সালে দু’টি আইন হয়: অ্যাসিড অফেন্সেস প্রিভেনশন অ্যাক্ট ও অ্যাসিড কন্ট্রোল অ্যাক্ট। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১২’য় যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অ্যাসিড হামলার সংখ্যা নেমেছে ৮৫’তে। সংস্থার অন্যতম প্রধান সেলিনা আহমেদ এরা-র মতে, এর পিছনে আছে অ্যাসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণ, অ্যাসিড হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক সরকারি-বেসরকারি প্রচার ও হামলাকারীদের কঠোরতম শাস্তি। |
|
বাংলাদেশের অ্যাসিড হামলা প্রতিরোধ আইনের সঙ্গে ভারতের আইন ও সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশিকার তুলনা করা যেতে পারে।
১. বাংলাদেশের আইনে, অ্যাসিড হামলায় কারও মৃত্যু হলে বা চোখ, মুখ, কান, স্তন, যৌনাঙ্গ নষ্ট হলে হামলাকারীর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। দেহের অন্য ক্ষতি হলে ৭-১৪ বছরের কারাদণ্ড। ভারতে এত দিন অ্যাসিড হামলার জন্য আলাদা আইনই ছিল না। দিল্লির বাসে ধর্ষিতা ছাত্রীর মৃত্যুর পর ভারতীয় দণ্ডবিধি সংশোধন করে ৩২৬এ ও ৩২৬বি ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ধার্য হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, যা ক্ষতিগ্রস্তকে দেওয়া হবে।
২. বাংলাদেশের আইনে রয়েছে, এই সংক্রান্ত কেসের তদন্ত ত্রিশ দিনের মধ্যে ও শুনানি নব্বই দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। অ্যাসিড হামলার দ্রুত বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল আছে। যদি ট্রাইবুনাল মনে করে কোনও আক্রান্তের অভিযোগ পুলিশ নিচ্ছে না, তা হলে তারা সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ করে বিচার শুরু করতে পারে। ভারতেও এ-রকম ব্যবস্থা হবে না কেন?
৩. কেউ অ্যাসিড-আক্রান্ত হলে তাঁর বাড়ির লোক প্রথমে কী করবেন, কোথায় যাবেন, কী ভাবে আইনি ব্যবস্থা নেবেন, সে বিষয়ে কোনও হেল্প লাইন বা প্রচার ভারতে নেই। বাংলাদেশে জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল ও তার জেলা কমিটি আছে, তারাই আক্রান্তকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, মামলার জন্য তাঁর আইনজীবী নিয়োগ করে, এমনকী কেস লড়ার টাকাও দেয়।
৪. নিয়ম মেনে অ্যাসিড বিক্রি হচ্ছে কি না বাংলাদেশে তা নজরদারিও করে এই কাউন্সিল। বিক্রির উপর কে নজরদারি চালাবে ভারতে তা অস্পষ্ট।
৫. অ্যাসিড-আহতদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশে আলাদা কেন্দ্র আছে। আছে জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ তহবিল। সেখানে সরকারি অনুদানের পাশাপাশি বেসরকারি অনুদান জমা পড়ে। সে টাকা আহতদের চিকিৎসার জন্য বণ্টন করা হয়। ভারতে এমন ব্যবস্থা নেই।
৬. শুধু অ্যাসিড-আহত ব্যক্তিদের জন্য ঢাকার বনানী এলাকায় ব্রিটেনের ডি এফ আই ডি’র সহায়তায় এক অত্যাধুনিক হাসপাতাল রয়েছে, নিখরচায় চিকিৎসার সুবিধা সহ। এ দেশে সরকারি হাসপাতালে বার্ন ইউনিটই দুর্লভ। যদিও বা থাকে, তাতে আধুনিক পরিষেবা মেলে না। রোগীদের রেফার করে দেওয়া হয় বেসরকারি হাসপাতালে, চিকিৎসা চালাতে গিয়ে রোগী নিঃস্ব হয়ে যান।
সত্যিই কি কিছু বদলাবে? |
|
|
|
|
|