|
|
|
|
প্রবন্ধ ৩... |
কার লজ্জা এই ‘অনার সেন্সর’
বাইরে চাকরি? খোয়াব। ঘরবন্দিই হতে হবে।
এখন পুরুষের গোড়ালি দেখলেও লাল ঝরে।
চৈতালী চট্টোপাধ্যায় |
আমার স্টকে গল্পের মতো, দু-চার পিস সত্য ঘটনা ছিল, স্মৃতির অতলে চাপা পড়ে যাওয়া। আজ যখন আলো ফুঁড়ে ভুস-ভুস করে অন্ধকার উঠে, ঢেকে দিচ্ছে আবহ, কালি মাখিয়ে দিচ্ছে আমাদের চোখে-মুখে, সেই গল্পগুলো মনে পড়ে গেল!
এই যেমন, কোনও এক চেনা মেয়ে আমার, বিবাহিতা, জার্নালিজম পড়ত। শ্বশুরবাড়িতে টিকতে না পেরে, ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে গিয়েছিল সে। তার বর যখন থানায় ডায়েরি করতে যায়, ভারপ্রাপ্ত অফিসার চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, ‘সে কী মশাই, বাড়ির বউকে জার্নালিজম পড়তে পাঠায় কেউ!’
এই যেমন, আমার বান্ধবী যখন মস্ত বড় বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি পাওয়ায় আহ্লাদে ডগোমগো, তার দাদার বিবাহ সূত্রে পাওয়া সদ্য-কুটুম্বেরা নাকি মন্তব্য করেছিল, ‘ছ্যা ছ্যা, রাতবিরেতে বাড়ি ফেরে, এই কি ভদ্রঘরের মেয়েদের কাজ!’
অনার কিলিং-এর কথা অনেক শুনেছি। একটা ‘অনার সেন্সরশিপ’ও কিন্তু সব সময়ই বহাল থেকেছে, মেয়েদের জন্য। বিধেয় হয়েছে এমন চাকরি, যাতে তারা সকাল সকাল অফিসে কিংবা স্কুল-কলেজে পড়াতে গিয়ে, আবার আলো থাকতেই ঘরে ফিরতে পারে। নিতান্তই, সন্ধেরাতে ফিরতে হলে, কিংবা ট্রেনে চেপে প্রবাসে যেতে হলে, সঙ্গে এক জন ‘ও’ বা ‘উনি’ মাস্ট! মেয়েটির বর, ভাই, দাদা, বাবা...
তো, তার পর এক দিন মেয়েরা স্বাধীন হল। সর্বত্রগামিনী হল। বিশ্বায়নের কারণে, উদার ও মুক্ত অর্থনীতির কারণে কর্পোরেটের চাকরি সামনে এল যখন, মেয়েরা চিনল বি পি ও, কল সেন্টার। তাদের জন্যেও নাইট শিফ্ট হল!
কিন্তু দেখতে দেখতে ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে সাংঘাতিক। |
|
ঝড়ে আর মেয়েদের মুখের আঁচল উড়ে যাওয়ার অবকাশ মেলে না, সে আঁচল ওড়ানোর জন্য নব নব প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আমাদের যুব সম্প্রদায়। নতুন নতুন ব্লু প্রিন্ট তৈরি হচ্ছে নারী শিকারের। সঙ্গের ‘পুরুষ গার্জেন’কে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মেয়েদের উপর হামলে পড়া চলে আজ। আগে যেমন শরীরের প্রাইভেট পার্ট (মেয়েদের ক্ষেত্রে, পুরুষের ক্ষেত্রে ও সব হাইলাইট করা কিংবা নিষেধাজ্ঞার বাহুল্য নেই কোনও) ঢেকেঢুকে রাখলেই, রাস্তায় অনেকটা নিরাপদ মনে হত নিজেদের, এখন নারীদেহের সবটাই প্রাইভেট পার্ট। শুধু বাহুমূল, কানের লতি, গোড়ালিটুকু দেখেও পুরুষের টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ হতে শুরু করে দিচ্ছে, যখন তখন। আর, তার মাচো ইমেজ, আবেগ নিয়ন্ত্রণের বদলে, মেয়েটিকে ছিন্নভিন্ন করারই নির্দেশ দেয় শুধু! এবং সেই নির্দেশ কার্যকর করতে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া, একা বা, অনেক সময়েই দল বেঁধে। দরকার হলে মোবাইলে ‘চলে আয়’ বলে দলবল ডেকে নেওয়া— কোনও ব্যাপার নয়।
নারী নরকের দ্বার। আগে, হয়তো বা মূল্যবোধের বশেই, এত সহজে নরকে যেতে চাইত না পুরুষ মানুষ। মেয়েদের সম্ভ্রম না করুক, দেখা মাত্রই নারীশরীরে উপগত হতে চাইত না। এখন, অস্ত্রশস্ত্রের ঝংকার চার পাশে, মুহূর্তে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মন্দির, মসজিদ, পাঁচতারা হোটেল, ব্রিজ কিংবা আস্ত রেলগাড়ি। এখন, হাতের কাছেই, নেট সার্চ করে, কিংবা সিনেমা হলের বিশাল স্ক্রিনে মিলছে নারী শরীর ভোগের অজস্র রকমসকম। ফলে, গোঁফ গজানোর আগেই মূল্যবোধ মিলিয়ে যায় হাওয়ায়! আর, তাই, চোখের সামনে, অফিসে, ঘরে, পথেঘাটে, নিরালায় কিংবা দুর্গম অঞ্চলে ‘সুলভ নরকদ্বার’ দেখতে পেলে, নরকগামী হতে আর বাধা কোথায়! আজ বুঝি, অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়া কিংবা পছন্দমত কেরিয়ার গড়ে তোলার স্বপ্ন শিকেয় তুলে আবার ঘরমুখী, অথবা ‘ভদ্র গোছের’ চাকরিমুখী হতে হবে মেয়েদের। বাঁচার তাগিদে জীবনটাকে সেন্সর করেই বাঁচতে হবে আবার। আধুনিকতার আশীর্বাদ।
একটা কথা খুব মনে হয় আজকাল। বেহুলা যখন মান্দাসে, স্বামীর শবদেহ নিয়ে ঘাটে, আঘাটায় ভিড়ছিলেন, অবমাননার নানা পরিস্থিতি সামনে এলেও, আর যা-ই হোক, গ্যাং-রেপ্ড হওয়ার আশংকা, সম্ভবত ছিল না কোনওখানে! |
|
|
|
|
|