প্রবন্ধ ১...
সব বিভেদ পেরিয়ে মেয়েরা যদি দল গড়ে?
দিল্লিতে গত বছর ১৬ ডিসেম্বরের সেই ভয়ঙ্কর ধর্ষণের কথা প্রথম শুনে যে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল, তা এখনও একটুও ভুলিনি। মুম্বইয়ে গত বৃহস্পতিবারের ঘটনাটির কথা জানার পরেও শিরায় শিরায় সেই একই তীব্র ক্রোধ অনুভব করলাম। এবং একই সঙ্গে মনে হল, বছর দুয়েকের মধ্যে কত বার এই এক অনুভূতির শিকার হয়েছি একের পর এক ঘটনায়— পার্ক স্ট্রিট, বারাসত, দিল্লি, কামদুনি, মুম্বই... আতঙ্কের তালিকা অন্তহীন। আমার রাগও নিষ্ফল।
ঘটনাগুলোই যেন যথেষ্ট ক্ষোভ, ক্রোধ এবং যন্ত্রণার জন্ম দেয় না, ভারতের রাজনীতিকরা তার সঙ্গে যোগ করেন একের পর এক ভয়ানক সব মন্তব্য। ইতিমধ্যে আমরা বিস্তর ‘সাজানো ঘটনা’র খবর পেয়েছি। অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। এই সাংসদ এক বারই সর্বভারতীয় সংবাদের শিরোনামে এসেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন, দিল্লির ধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিলে যে মেয়েরা হেঁটেছেন তাঁরা সব ‘সাজগোজ করা, মুখে-রং-মাখা’ শহুরে মেয়ে। এতদ্দ্বারা তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, তিনিই জানেন, কিন্তু দিল্লির হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় যাঁরা জলকামান আর পুলিশের লাঠির মোকাবিলা করলেন তাঁদের সম্পর্কে এ-রকম মন্তব্য করা যায়, এটাই একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত তো বলে দিলেন, ধর্ষণ হল ‘ইন্ডিয়া’র ব্যাপার, ‘ভারত’-এ ও-সব হয় না! ভাগবত যদি প্রাথমিক খোঁজখবরটুকুও নিতেন, তা হলে জানতে পারতেন, কী ভয়ানক ভুল তাঁর এই ধারণা। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ভারতে রাজনীতির কারবারিরা অনেক সময়েই ইচ্ছে করে এ-ধরনের মন্তব্য করেন। ভোটের জন্য, প্রচারের আলোয় থাকার জন্য তাঁরা এমন কথাবার্তা বলতেও পিছপা হন না, যা হিংসা ছড়াতে পারে। মুম্বইয়ের ঘটনাটিকে ইতিমধ্যেই শিবসেনা উত্তর ভারতীয়দের প্রতি তাদের পরিচিত বিদ্বেষ সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করেছে।
অথচ দেশের ঠিক কোন জায়গাটুকু মেয়েদের পক্ষে নিরাপদ? মোহন ভাগবতের ‘ভারত’ যদি নিরাপদ হয়, তবে কামদুনির মর্মান্তিক ঘটনাটি কী করে ঘটল? বারাসতে জেলাশাসকের বাংলো থেকে একশো মিটার দূরে গুন্ডাদের কবল থেকে দিদিকে বাঁচাতে গিয়ে রাজীব দাসকেই বা মরতে হয়েছিল কেন? বারাসত কি তবে যথেষ্ট ‘ভারত’ নয়! সুটিয়ার মেয়েরাও ভারতের নন বুঝি?

‘মেয়েদের’ সমস্যা! ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সত্য এই যে, ভারতে সর্বত্র মেয়েরা বিপন্ন। কাশ্মীর আর উত্তর-পূর্ব ভারতের সেনা-কবলিত এলাকায়, কেরলের মতো শিক্ষায় অগ্রসর রাজ্যে কিংবা তামিলনাড়ু বা পশ্চিমবঙ্গের মতো মহিলা মুখ্যমন্ত্রী শাসিত রাজ্যে, কোথাও তাদের যথেষ্ট নিরাপত্তা নেই। বাড়িতে, স্কুলে, রেল স্টেশনে, পাবলিক টয়লেটে, মুম্বই কলকাতা দিল্লির ঝলমলে রাজপথে, উত্তরপ্রদেশ ঝাড়খণ্ড অসম পশ্চিমবঙ্গের অন্ধকার কাঁচা রাস্তায় সর্বত্র মেয়েরা বিপন্ন। ইন্ডিয়া বনাম ভারতের তুলনামূলক ভাগবতীয় বিশ্লেষণে আমার কোনও অভিরুচি নেই, উচ্চবর্ণের মেয়েদের তুলনায় দলিত মেয়েরা কত বেশি হিংসার শিকার, তার তুল্যমূল্য বিচারও আমি করতে চাই না। বরং অবাক হই, যখন আশিস নন্দীর মতো সুপরিচিত সমাজবিজ্ঞানী এই ধরনের তুলনাকে গুরুত্ব দেন, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন। বলিউড ফিল্ম আর তার ‘আইটেম নাম্বার’ এ-সব অপরাধের জন্ম দেয় কি না বা এর পিছনে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কতখানি ভূমিকা, আমি তা নিয়েও ভাবতে রাজি নই। এই ধরনের অপরাধের ঘটনা সাম্প্রতিক কালে বেড়েছে, না কি মিডিয়াতে এখন সেগুলি অনেক বেশি প্রচারিত হচ্ছে, সেই তর্কেও আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। এর কোনওটাই সম্পূর্ণ মিথ্যে নয়, কিন্তু এগুলোই বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়।
একটা কথা খেয়াল করে মনটা খুব ভারী হয়ে গেল। মুম্বইয়ে মেয়েটি দিনের যে সময়ে আক্রান্ত হয়েছে তাকে আমরা বাংলায় ‘গোধূলি’ বলি। এই সেই সময়, যখন গোঠে-ফিরে-চলা গোরুর খুরের ঘায়ে ধুলো ওড়ে, সেই ধুলোয় অস্তগামী সূর্যের নরম আলো আরও নরম, আরও মায়াময় লাগে। ফোটোগ্রাফার মেয়েটি ওই আলো ধরতে চেয়েছিল তার ছবিতে। তার নিয়তি তার জন্য অন্য কিছু বরাদ্দ করে রেখেছিল। মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠে কাজে ফিরুক, তার সাহস এবং মনের জোরকে আমি কুর্নিশ করি।
কিন্তু এই নির্ভীক তরুণ সাংবাদিকের ঘুরে দাঁড়াতে চাওয়ার খবরটা আমার মনে একটি কল্প-ভাবনা ফিরিয়ে আনছে। ভাবনাটা নতুন নয়, আমি অনেক দিন ধরে এ ভাবনা মনের মধ্যে লালন করছি। একে কল্প-ভাবনাই বলা ভাল, কারণ এর বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু যাঁর মন আছে, তিনিই কি ভাবছেন না, সম্ভব-অসম্ভব কোন পথে এই দেশটাকে মেয়েদের পক্ষে নিরাপদ করে তোলা যায়? মেয়েদের জন্য নিরাপদ করার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে সব পুরুষকে সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। এর মানে এই নয় যে ভাবতে হবে সব পুরুষের মনে ধর্ষণের ইচ্ছা সুপ্ত থাকে। মেয়েদের নিরাপত্তার দাবি মানে কিন্তু পুরুষবিরোধিতার ধুয়ো নয়।
কিন্তু এটা সত্যি কথা যে, ভারতে এই ধরনের ঘটনা এখনও ‘মেয়েদের’ সমস্যা বলে গণ্য করা হয়, সকলের সমস্যা হিসেবে নয়। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা সত্যি কথা হল, মোমবাতি-মিছিল বা রাজপথের প্রতিবাদ, সবই দেখিয়ে দেয়, ভারতে যতক্ষণ না একটা সমস্যাকে ভোটের রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো যায় ততক্ষণ তার প্রতিকারের কোনও চেষ্টা হয় না। মেয়েদের নিরাপত্তা বিপন্ন হলে যদি ভোটের বাজারে তার কোনও প্রভাব না পড়ে, তা হলে বেশির ভাগ রাজনীতিক এ নিয়ে একটুও মাথা ঘামাবেন না। আর এ দেশের পুলিশ এবং প্রশাসনের টিকি তো রাজনীতিকদের কাছেই বাঁধা: দুর্গাশক্তি নাগপাল বা দময়ন্তী সেনের অভিজ্ঞতা সম্প্রতি কালে তা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। ভারতের মেয়েদের সামনে তাই এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ: কী ভাবে তাদের ‘নিজেদের’ এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা যায়, আর কী ভাবে রাজনীতির মঞ্চে সরাসরি সমস্যাটাকে নিজেরাই এনে হাজির করা যায়।
এ দেশে যে হাজার রকমের বিভেদ আছে— জাতপাতের বিভেদ, ধর্মের বিভেদ, আঞ্চলিকতার বিভেদ, কমিউনিটির বিভেদ— এগুলো তো সবই আইডেন্টিটির রাজনীতির ভিত্তি হয়ে গিয়েছে। এ বার যদি মেয়েরা নেমে পড়ে আইডেন্টিটির রাজনীতির মঞ্চে? অন্যান্য জাত ধর্ম অঞ্চল ইত্যাদি বিভেদ অতিক্রম করে একজোট হয়ে তারা যদি লড়াই করতে নামে? ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে মেয়েরা যদি নিজেদের জন্য একটি অভিন্ন দাবিপত্র পেশ করে? নিজেদের বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক ভেদাভেদ সত্ত্বেও (বস্তুত সেই বিভিন্নতাকেই নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির কাজে লাগিয়ে) যদি সমস্বরে রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রকাশ্য বিতর্কে বাধ্য করে? ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টগুলি যাতে ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে, চার্জশিট যাতে দ্রুত এবং যথাযথ ভাবে দাখিল করা হয়, গ্রামে ও শহরে যাতে কাউন্সেলিং-এর সুযোগ থেকে শুরু করে আলো এবং এমার্জেন্সি ফোন অবধি বিভিন্ন জরুরি বন্দোবস্ত করা যায়, সে জন্য রাজনীতিকদের যদি বাধ্য করতে চায়? এই যে দিল্লি ধর্ষণকাণ্ডের পর মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য হাজার কোটি নির্ভয়া-ফান্ড তৈরি হল, আজ পর্যন্ত তা ফাইলেই বন্দি! মেয়েরা যদি নিজেরা রাজনৈতিক দল বানিয়ে এগিয়ে আসে, বরাদ্দ টাকা কাজে লাগানোর দাবি জানায়, তাদের দাবি না মানা হলে তারা সরকার ফেলে দেবার ক্ষমতা রাখে এটা যদি প্রতিষ্ঠা করতে পারে— একমাত্র তবেই হয়তো এই অনন্ত অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটতে পারত!
আইনসভায় মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষণের প্রস্তাবিত বিলটি নিয়ে যে কাণ্ডকারখানা আমরা দেখেছি, তাতে ‘ভারতীয় মেয়ে’ বলে কিছু দেখা যায় না, দেখা যায় কেবল নানা গোষ্ঠীর মেয়ে: হিন্দু, মুসলিম, দলিত, নাগা, মরাঠি, হিমাচলি, শহুরে, মফস্সলি, গ্রামীণ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ভারতীয় মেয়ে’? আমরা কি এমন একটা নারী আন্দোলনের কথা ভাবতে পারি, যা প্রথমেই প্রশ্ন তুলবে না দলিত মেয়ে না শহরের মেয়ে, নাগা মেয়ে না মরাঠি মেয়ে? বরং এ সব বিভিন্নতাগুলি স্বীকার করে, কিন্তু মেয়েদের সেই খণ্ড-পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে ‘ভারতীয় মেয়ে’র একটা সামগ্রিক ধারণা নির্মাণ করতে পারবে? দেশের সমস্ত মেয়ের জন্য কিছু অধিকারের দাবিতে এমন একটা সমষ্টি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরাই এখন ভারতীয় মেয়েদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যান্য আইডেন্টিটি-গোষ্ঠী যেমন ক্রমাগত সরকারকে চাপের মুখে রাখতে পারে, তেমনই মেয়েদের দাবি পূরণ করতে না পারলেও ২০১৪’র নির্বাচনে হেরে যেতে হবে— এই একটা ভয় রাজনৈতিক দল, নেতা বা জনপ্রতিনিধির মনে ঢোকাতে পারাটা খুব দরকার ছিল।
এটাই আমার সেই কল্প-ভাবনা। আমার স্বপ্ন। নির্ভয়া/দামিনীদের কথা, কামদুনির তরুণ প্রতিবাদিনীদের কথা, মুম্বইয়ের ফোটোগ্রাফার মেয়েটির কথা যখন পড়ি, এই স্বপ্নকে কথায় প্রকাশ করার সাহস পাই।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.