হঠাৎই অযোধ্যা অভিমুখে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। আপাত লক্ষ্য: রামমন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করিয়া ঘুমন্ত হিন্দু আবেগ জাগাইয়া তোলা। নিহিত লক্ষ্য: নির্বাচনের আগে আবার এক দফা রাজনৈতিক মেরুকরণ। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদদের হইচই, মুলতুবি প্রস্তাব, সভা ভণ্ডুল করার মরিয়া প্রচেষ্টা সংকেত দেয়, সংঘ পরিবার হিন্দু ভোট সংহত করিতে রামমন্দিরের অচল পয়সাকে আবার চালু করার চেষ্টা করিতেছে। ইহা অবশ্যই একটি ‘রাজনৈতিক যাত্রা’। রামলালার জন্য একটি পছন্দসই আবাস নির্মাণ করার তাগিদটি ধর্মীয় হইলে পাঁচ বছর ধরিয়া তাহার সুপ্ত থাকিবে কেন? সর্বদাই ধর্মপ্রাণ রামচন্দ্র-অনুগামীদের মনে তাহা জাগরূক থাকার কথা।
অথচ দেখা যায়, ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে এই ‘ধর্মীয়’ আবেগ মাথা চাড়া দেয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল, দুর্গা বাহিনী ইত্যাদি সংঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলি সহসা অতি-সক্রিয় হইয়া ওঠে, হাতে-হাতে ত্রিশূল ঘুরিতে থাকে, রক্তাম্বর বস্ত্র পরিধান করিয়া তিলক-লাঞ্ছিত গৈরিক বাহিনী ‘হর-হর মহাদেব’ ধ্বনিতে আর্যাবর্তের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করিতে থাকে। অপরিচয় হইতে প্রখর দিবালোকে উদ্ভাসিত হইতে বাহির হইয়া আসেন অশোক সিঙ্ঘল, মহন্ত অবৈদ্যনাথ, প্রবীণ তোগাড়িয়া ও নৃত্যগোপাল দাসের মতো ধর্মধ্বজীরা। ধর্মাচরণে ভারতীয় সংবিধান কাহাকেও বাধা দেয় না। কিন্তু একের ধর্মাচরণ যদি অন্যের ধর্মকে দলন করিতে উদ্যত হয়, গোল বাধে তখনই। বিগত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা সাক্ষী, রামমন্দির নির্মাণের কর্মসূচি ও তাহার রূপায়ণে বিবিধ প্রকার স্বেচ্ছাসেবীর ঝটিকাবাহিনী একটি সাড়ে চারশত বৎসরের প্রাচীন ইসলামি ধর্মস্থান ধূলিসাৎ করিয়াছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অগণিত সংখ্যালঘুর প্রাণনাশ করিয়াছে এবং তাহার জেরে মুম্বই বিস্ফোরণ হইতে শুরু করিয়া মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের তাণ্ডবকেও একপ্রকার নেতিবাচক বৈধতা দিয়াছে। রামমন্দির লইয়া কোনও রকম আবেগের মোকাবিলায় তৎপর থাকা অতএব প্রশাসনের দায়িত্ব।
উত্তরপ্রদেশে অখিলেশপ্রসাদ যাদবের সরকার তাই অযোধ্যার চারিপাশে যে নিশ্ছিদ্র অবরোধ গড়িয়াছে, যে ভাবে পরিষদ নেতৃত্ব-সহ অন্তত দেড় হাজার যাত্রাকারীকে গ্রেফতার করিয়াছে, তাহার প্রশাসনিক যুক্তিকে উড়াইয়া দেওয়া চলে না। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই বিজেপি সংসদের উভয় কক্ষে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়াছে। তবে বিজেপি নেতৃত্বও সম্ভবত জানেন, রামমন্দির কেন্দ্রিক আবেগ আর হিন্দু জনসমাজকে মথিত করে না। ভোটার হিসাবে একজন ভারতীয় নাগরিক যখন নির্বাচনী বুথের লাইনে দাঁড়ান, তখন অযোধ্যায় রামমন্দির হইল কি না, সেই আধ্যাত্মিক প্রশ্নের চেয়েও সড়ক-বিজলি-পানির মতো নিতান্ত জাগতিক জিনিসগুলি তাঁহাদের আয়ত্তে আসিল কি না, সে বিষয়ে অধিক ভাবিত থাকেন। ভোটের লাইনে তাঁহারা প্রধানত ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের নাগরিক, নিছক হিন্দু নহেন। ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের ভিত্তিতে দেশবাসীর মেরুকরণের প্রয়াস তাই উত্তরোত্তর ব্যর্থই হইতেছে। মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্রকে, রামায়ণ মহাকাব্যের নায়ক সীতাপতিকে তাঁহারা নিশ্চয় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে রাখিয়া দেন। কিন্তু তাঁহার জন্য এই মর্ত্যধামে বাসস্থানের অভাব হইয়াছে, এমত ভাবনায় উদ্বিগ্ন হইয়া তাঁহারা ভোট দেন না। বিজেপি নেতৃত্ব কিংবা তাঁহাদের অভিভাবক সংঘ পরিবার বিষয়টি মাথায় রাখিলে ভাল করিবেন। |