এক একটি শহরের এক এক রকম খ্যাতি থাকে। মুম্বই, অনতি অতীতেও, মহিলাদের জন্য অতি নিরাপদ শহর হিসাবে খ্যাত ছিল। সেই শহরেরই ৮২ শতাংশ কর্মরত মহিলা যখন বলেন যে তাঁহারা চাকুরির খাতিরে পথে বাহির হইয়া নিজেদের সুরক্ষা লইয়া দুশ্চিন্তায় ভোগেন, তখন বুঝিতে হয়— ভারত বিপন্ন। পরিত্যক্ত কারখানায় গণধর্ষিতা চিত্র-সাংবাদিক তরুণী এই বিপন্নতার মুখমাত্র, দিল্লি বা কামদুনির তরুণীরা যেমন ছিলেন। মুম্বইয়ের ঘটনাটিতে পাঁচ সন্দেহভাজনকে পুলিশ গ্রেফতার করিয়াছে। তাহারা বলিয়াছে, ইহাই প্রথম নহে, তাহারা পূর্বেও এই ঘৃণ্য অপরাধ করিয়াছে। বস্তুত, দেশের পুং-সমাজের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এখনও ধর্ষণকে পৌরুষের প্রকাশ হিসাবেই দেখে— মৃগয়ার ন্যায়। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করিতেছে, এই পুরুষরা রাষ্ট্রকে ভয় করে না। রাষ্ট্র যথেষ্ট ভয়ের ব্যবস্থা করিতে পারে নাই। ধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় নাই, বিচারপ্রক্রিয়ায় গতি আসে নাই। অতএব, পৌরুষের খেলায় মাতিতে ধর্ষকরা দ্বিধা বোধ করে না। সমাজও খুব বিচলিত, ভাবিবার কোনও কারণ নাই। মুম্বইয়ের তরুণীর ক্ষেত্রে বরং একটি বিপজ্জনক প্রবণতার ইঙ্গিত মিলিতেছে। তরুণী জানাইয়াছেন, তিনি যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়া আসিতে চাহেন। তাঁহার এই সাহস প্রশংসনীয়। কিন্তু, এক ধর্ষিতা তাঁহার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের চাপ সরাইয়া স্বাভাবিক ভাবে বাঁচিতেছেন, এমন ঘটনায় সমাজের প্রতিক্রিয়া কী হইবে? ‘তাহা হইলে খুব বেশি অন্যায় হয় নাই’ ভাবিয়া সমাজ মুখ ফিরাইয়া লইবে না তো? তাঁহার সাহস তাঁহার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকে ‘লঘু’ করিয়া তুলিবে না, সমাজের নিকট এই প্রাপ্তমনস্কতা তরুণীটি আশা করিতে পারেন কি? সংশয় হয়।
সংশয়টি ভিত্তিহীন নহে। দিল্লির ধর্ষিতা তরুণীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর সরকারি মহলে তৎপরতার বান ডাকিয়া গিয়াছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মহিলাদের সুরক্ষার খাতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছিলেন। তাহার পর যমুনায় অনেক জল বহিয়াছে— মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্নের ফাইল নড়ে নাই। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক এখনও স্থির করিতে পারে নাই, বরাদ্দ টাকায় ধর্ষিতাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হইবে, না কি টাকাটি সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হইবে। অন্যান্য মন্ত্রকও তথৈবচ। মুম্বইয়ের ধর্ষণের পর সনিয়া গাঁধী নাকি তিরস্কার করিয়াছেন, ফলে কাজে কিঞ্চিৎ গতি আসিয়াছে। দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে নাড়া দিতে আরও কতগুলি ধর্ষণ চাই?
আরও একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। দিল্লির ঘটনাতেও ধর্ষকদের এক জন আইনত অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। মুম্বইয়েও অভিযুক্ত পাঁচ জনের মধ্যে দুই জনের বাড়ির লোক দাবি করিতেছে, তাহাদের বয়স আঠারোর কম। দিল্লির অপ্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষকের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট জানাইয়াছিল, যত মারাত্মক অপরাধেই অভিযুক্ত হউক না কেন, অপ্রাপ্তবয়স্কের বিচার আলাদা হইবে। শীর্ষ আদালতের রায়ের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াও এই পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রশ্ন তোলা হইয়াছিল— কোনও একটি নির্দিষ্ট বয়ঃক্রমকে বয়ঃপ্রাপ্তির চৌকাঠ হিসাবে বাঁধিয়া দেওয়া কি ঠিক? আজকের এই বিনোদন-প্রচারের বিস্ফোরণের যুগে কি সনাতন চৌকাঠটির সংশোধনীও কাম্য নহে? আরও এক বার এই প্রশ্নটি তোলা প্রয়োজন। অপরাধের পিছনে যে মনটি কাজ করে, তাহারও হিসাব নেওয়া প্রয়োজন। চৌর্যবৃত্তি আর ধর্ষণ এক গোত্রের অপরাধ নহে। যে অপ্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষণের ন্যায় মারাত্মক অপরাধ করিতে পারে— বস্তুত, দিল্লির ধর্ষণকাণ্ডে অপ্রাপ্তবয়স্কটিই সর্বাপেক্ষা নৃশংস আচরণ করিয়াছিল বলিয়া প্রকাশ— তাহাকে শুধুমাত্র বয়সের কারণেই অতি লঘু শাস্তি দিলে তাহা ন্যায়বিচার হয় কি? এই প্রশ্নটির উত্তর নূতন করিয়া খুঁজিতেই হইবে। |