জামিন পেয়ে হৃদয় বললেন, নৈতিক জয় |
আট মাসে আটটি পৃথক মামলা। তার মধ্যে পরপর দু’দিনে দায়ের হয়েছে চারটি মামলা। এরই সঙ্গে রয়েছে পুলিশেরই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে দায়ের করা আরও একটি মামলা। প্রত্যেকটিই জামিন অযোগ্য। এবং সব ক’টিতেই অভিযুক্ত তৃণমূলের কসবা পঞ্চায়েত এলাকার বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরাই। সোমবার তারই একটিতে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী হৃদয় ঘোষ-সহ ১০ জনকে আগাম জামিন দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
ওই নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, প্রবল বিরোধিতার আশঙ্কা করে পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকেই কসবার বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে এ ভাবেই মিথ্যা মামলা সাজাতে শুরু করেছিল তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীরা। শুধু নেতাদের বিরুদ্ধেই নয়, পঞ্চায়েতে কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন, তা অনুমান করে তাঁদেরও একাধিক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে। যার জেরে ভোটের বহু আগে থেকেই গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে পড়েন অধিকাংশ বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীই। গত মার্চেই তাঁরা একবার কলকাতা হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছিলেন। ফের গত ৫ অগস্ট ১৪ জুলাই পাড়ুই থানায় দায়ের হওয়া একাধিক জামিন অযোগ্য মামলার দু’টিতে জামিনের আবেদন করেছেন কসবার ওই বিক্ষুব্ধেরা। আবেদনকারীর অন্যতম বাঁধ নবগ্রামের নিহত সাগরচন্দ্র ঘোষের ছেলে, কসবা পঞ্চায়েতের পরাজিত নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষ। নব গঠিত কসবা পঞ্চায়েতের নির্দল প্রধান শঙ্করী দাসের স্বামী নিমাই দাস, জয়ী নির্দল সদস্য শেখ বিরাজুল, শঙ্করীদেবীর দুই দেওর মানিক দাস ও সোমনাথ দাস, দলের অঞ্চল সম্পাদক বিকাশ মণ্ডল, সভাপতি নিখিল পাল ও চেয়ারম্যান নারায়ণচন্দ্র ভাণ্ডারী-সহ অনুব্রত-বিরোধী গোষ্ঠীর একাধিক তৃণমূল নেতা কর্মীও ওই আবেদন করেছেন।
পঞ্চায়েত ভোটের ফলে কসবা পঞ্চায়েতে অনুব্রত অনুগামী বনাম নির্দলদের অবস্থা ছিল ৬-৬। গত ১৭ অগস্ট লটারিতে বোর্ড দখল করেছে নির্দলেরাই। প্রধান হয়েছিলেন শঙ্করী দাস, উপপ্রধান পার্বতী বাগদী। তাঁদের অভিযোগ, ভোটের আগে থেকেই কসবা পঞ্চায়েতকে নিজেদের দখলে রাখতে শাসক দলের জেলা সভাপতি তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নির্দল প্রার্থী এবং তাঁদের সহযোগীদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জেলের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তৃণমূলেরই কসবা অঞ্চল সম্পাদক বিকাশ মণ্ডল (একাধিক মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে তাঁকেও) বলছেন, “কাকে ফাঁসানো হয়নি! এক এক জনের বিরুদ্ধে কুড়িটিরও বেশি জামিন অযোগ্য ধারায় মিথ্যা মামলা করেছে জেলা সভাপতির অনুগামীরা। নিহত সাগরচন্দ্র ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষকেও জড়ানো হয়েছে একাধিক মামলায়।” মামলা দায়ের হয়েছে কসবার বাঁধ নবগ্রাম সংসদ থেকে জয়ী নির্দল প্রার্থী শঙ্করী দাসের পরিবারের প্রায় সকলের নামেই। বিকাশবাবুর অভিযোগ, “অস্ত্র আইন, বোমাবাজি, অগ্নি সংযোগ, খুনের চেষ্টা, বেআইনি জমায়েত-সহ একাধিক ধারায় ভুয়ো মামলা করেছে অনুব্রতর অনুগামীরা। একদিকে মিথ্যা মামলায় পুলিশের গ্রেফতারি এড়াতে হচ্ছে, অন্য দিকে জেলা সভাপতির অনুগামীদের হামলা থেকেও বাঁচতে হচ্ছে। যার জেরে সেই ডিসেম্বর থেকে আমরা নিজেদের এলাকায় ঢুকতে পারছি না।”
|
নিশানায় বিক্ষুব্ধেরা দায়ের হওয়া মামলা |
তারিখ |
কেস নম্বর |
অভিযুক্ত |
০১.১২.১২ |
১০৭/১২ |
১৮ জন |
০৯.১২.১২ |
৬২১/১২* |
১৬ জন |
১০.১২.১২ |
১০৯/১২ |
২২ জন |
০৪.০১.১৩ |
৫/১৩ |
১৫ জন |
১৭.০২.১৩ |
২৩/১৩ |
৮ জন |
১৪.০৭.১৩ |
৬৭/১৩ |
১০ জন |
১৪.০৭.১৩ |
৬৮/১৩ |
৮ জন |
১৪.০৭.১৩ |
৬৯/১৩ |
১৭ জন |
১৫.০৭.১৩ |
৭৩/১৩ |
৩৭ জন |
*এটি ছাড়া পাড়ুই থানায় দায়ের হওয়া প্রত্যেকটি মামলাতে অভিযোগকারী তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী বলেই পরিচিত। |
|
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্তই ওই বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে চারটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। একই সময়ে পুলিশও বেআইনি ভাবে জমায়েত করার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে। অভিযুক্তদের দাবি, পুরোপুরি মিথ্যা অভিযোগে তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে। দলের জেলা সভাপতির বিরোধিতা করার জেরেই তাঁদের মামলা করে জেলে পাঠানোর চক্রান্ত করা হয়েছে। এরপরে পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে যায়। দিন নিয়ে শুরু হয় রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের চাপানউতোর। ফলে অনুব্রত অনুগামী ও বিরোধীদের তর্জা খানিকটা কমে আসে। কিন্তু জুন মাসে পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে এলাকা ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মহকুমার অন্যান্য জায়গার মতোই কসবা পঞ্চায়েত এলাকাতেও বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দেওয়া শুরু হয় বলে অভিযোগ। প্রথমে ব্লক অফিসে পরে মহকুমাশাসকের দফতরে রোজ দিন গণ্ডগোল শুরু হয়। প্রায় দিনই অনুব্রত-গোষ্ঠী ও বিরোধীদের একে অপরকে তেড়ে যেতে দেখা যায়। এক বিক্ষুব্ধ নেতার কথায়, “এরপরেও আমরা অনেকেই মনোনয়ন জমা করি। কিন্তু প্রচার পর্বে অনুব্রত-গোষ্ঠীর লোকজন সন্ত্রাসের রাস্তা নেয়। আমাদের প্রচারে বাধা পরপর মিথ্যা মামলা করা হয়। ওরা ভেবেছিল গ্রেফতার হলে আমরা কিছুই করতে পারব না। কিন্তু এতো করেও অনুব্রত কসবার বোর্ড দখলে বাজিমাত করতে পারলেন না!”
কসবা এলাকার তৃণমূলের অঞ্চল চেয়ারম্যান (অনুব্রত-বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা) নারায়ণচন্দ্র ভাণ্ডারী ও সভাপতি নিখিল পালরা বলছেন, “ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে লড়াই রুখতে আমাদের বিরুদ্ধে তো বটেই এমনকী সম্ভাব্য প্রার্থী ও ডামি প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও জেলা সভাপতির গোষ্ঠীর লোকজন জামিন অযোগ্য ধারায় মিথ্যা মামলা করে। আমরা এলাকা ছাড়া থেকে কোনও রকমে ভোটের মনোনয়ন জমা করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল ওই গোষ্ঠীর হাত থেকে কসবাকে দখলমুক্ত করা।” ওই ‘মিথ্যা’ মামলাগুলিতে তাঁদের বেশ কয়েক জন নেতা-কর্মীকে পুলিশ ধরে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
এ দিকে দলের জেলা সভাপতির বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের জামিন অযোগ্য ধারায় মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাত্তোরে দলের অঞ্চল সম্পাদক শেখ মুস্তফা। তাঁর পাল্টা দাবি, “অপরাধ করেছে তাই মামলা করা হয়েছে। ওরা আমাদের কর্মী-সমর্থক এমনকী, আমাকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে।” এ দিন সন্ধ্যায় নারায়ণবাবু অবশ্য বলেন, “ওই মিথ্যা মামলাগুলির একটিতে কলকাতা হাইকোর্ট ফের আমাদের আগাম জামিন দিল। এতে নৈতিক জয় আমাদেরই হল।” অন্য দিকে, পাড়ুই থানার পুলিশ জানিয়েছে, উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু হয়েছে। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।
এ দিন হৃদয়বাবু বলেন, “নিরপেক্ষ তদন্ত হলে কোনও মামলাই টিকবে না। জামিন মেলায় আমাদেরই নৈতিক জয় হল।” আর অনুব্রত বলেন, “এ নিয়ে আমি আর কী বলব!”
|