চাপা আশঙ্কা ছিলই। ঘটলও তাই।
রাসায়নিক অস্ত্র হানায় আক্রান্ত সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের শহরতলি পরিদর্শনে যাওয়ার পথে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের হামলার নিশানা হল রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষক দল। রাষ্ট্রপুঞ্জ সূত্রে খবর, কেউ হতাহত হননি। কিন্তু একাধিক গুলি লাগায় ভেঙে চুরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে পর্যবেক্ষক দলের কনভয়ের একটি গাড়ি। এর জেরে তদন্ত বন্ধ রাখতে বাধ্য হন দলের সদস্যরা। রবিবারই পর্যবেক্ষক দলকে আক্রান্ত এলাকাগুলি পরিদর্শনের ‘অনুমতি’ দিয়েছিল আসাদ-সরকার। কিন্তু তার পরেই এমন ঘটনা ঘটায় সিরিয়ার ভিতরে ও বাইরে উত্তেজনা বাড়ল বলেই ধারণা আন্তর্জাতিক মহলের।
আসলে বুধবারের হামলার পর পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলি ভিতরে ভিতরে যে সিরিয়ায় সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, তার খানিকটা আঁচ ইতিমধ্যেই মিলেছে। তবে তাতে মোটেও দমছেন না সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট। সোমবার একটি রুশ দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দৃঢ় ভাবেই রাসায়নিক হামলার দায় অস্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর যুক্তি, “সিরিয়ার সেনা যে সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে সে সব জায়গায় সিরিয়াই রাসায়নিক অস্ত্রের আঘাত হানতে পারে? এটা তো প্রাথমিক নীতির বিরোধী।” |
দামাস্কাসে হোটেল থেকে বার হচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভয়। এই কনভয়েরই
একটি গাড়ির উপরে সোমবার হামলা হয়। ছবি: এএফপি |
অর্থাৎ তাঁর দাবি, দামাস্কাসের যে তিন শহরতলিতে রাসায়নিক অস্ত্র হানা হয়েছে, সেখানে উপস্থিত ছিল সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একাংশও। এমনকী, তাঁদের মধ্যে কারও কারও মৃত্যুও হয়েছে বিষ-গ্যাসে। অতএব রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এ হেন হামলায় তাঁর হাত যে নেই, সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন তিনি।
তবে এ দিন আমেরিকাকেও এক হাত নিয়েছেন তিনি। স্পষ্ট ভাষায় আসাদ জানান, আমেরিকা যদি তাঁর দেশের মাটিতে ঢোকার চেষ্টা করে, তা হলে শুধু ব্যর্থতাই জুটবে ওবামার ভাগ্যে। ঠিক যেমন ভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ-সহ একাধিক ক্ষেত্রে নিজের হাত পুড়িয়েছে আমেরিকা, এ বারও ঠিক সেই পরিণতি হবে, মনে করিয়ে দেন আসাদ।
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও আসাদের এমন ‘গলার জোর’-এর পিছনে অবশ্য বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দুই দেশ রাশিয়া এবং চিনের সমর্থনকেই কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই আসাদের পাশে দাঁড়িয়েছে মস্কো এবং বেজিং। এমনকী, সিরিয়ার সেনাকে গোপনে অস্ত্রও সরবরাহ করেছে তারা, এমন অভিযোগ বেশ পুরনো। বস্তুত, সেনা হামলার কথা ভাবলেও এখনও পর্যন্ত যে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স যে সিরিয়া আক্রমণ করছে না, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ মস্কো এবং বেজিং-এর সমর্থন। গত কাল রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভ্রভ আমেরিকার বিদেশসচিব জন কেরিকে সিরিয়ায় মার্কিন সেনা হামলার বিষয়ে সতর্ক করেন। তার পরেই রুশ পত্রিকায় আসাদের সাক্ষাৎকার। সব মিলিয়ে ছবিটা তাই পরিষ্কার।
কিন্তু তা বলে আসাদের অত্যাচার মেনে নেওয়ার কথা ভাবছে না ব্রিটেন। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে সভাপতিত্ব করতে ছুটি বাতিল করে তড়িঘড়ি লন্ডন ফিরেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট সূত্রের দাবি, আমেরিকার সঙ্গে যৌথ ভাবে যে ক্ষেপণাস্ত্র হানার পরিকল্পনা করছে ব্রিটেন, তা নিয়ে আলোচনা করতেই এই বৈঠক। ব্রিটেনের বিদেশমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এ দিন সকালেই বলেন, “ব্রিটেন আমেরিকা এবং ফ্রান্স-সহ একাধিক দেশের কাছে অন্তত এটা পরিষ্কার যে একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা নির্বিচারে রাসায়নিক হামলা মেনে নেব না।” কিন্তু কবে নাগাদ পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে ব্রিটেন? সে বিষয়ে অবশ্য সোমবারও স্পষ্ট কিছু বলেননি হেগ। তবে যে কোনও সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। অর্থাৎ সেনা হানার কথা প্রত্যক্ষে স্বীকার না করলেও পরোক্ষে তারই ইঙ্গিত মিলছে বলে ধারণা একাংশের।
হেগের দাবি, বুধবারের হামলার পর পরই রাষ্ট্রপুঞ্জের তদন্ত চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তবে তার প্রায় চার দিন পর মিলল সুযোগ। এত দিন ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে প্রমাণ যা ছিল, তার সিংহভাগই নষ্ট করে ফেলেছে সিরিয়ার সেনা। তার পরেও পরিদর্শনে যাওয়ার পথে রাষ্ট্রপুঞ্জের পর্যবেক্ষক দলের উপর এই হামলা আসলে আসাদের উদ্দেশ্যই পরিষ্কার করছে। অসমর্থিত সূত্রের দাবি, ভূমধ্যসাগরে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি কম্যান্ডাররা হামলার প্রস্তুতি শুরু করেছেন । ব্রিটেনের মতো ফ্রান্স এবং জার্মানিও কড়া পদক্ষেপের ব্যাপারে একমত। কিন্তু আমেরিকার অবস্থান নিয়ে এখনও ধন্দে বিশ্ব। ক্যামেরন-ওবামা ফোনালাপ সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে ইরাক-যুদ্ধের স্মৃতি মাথায় রেখেই সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যায় হাত দেওয়ার আগে সাবধানী ওবামা-প্রশাসন।
তবে সোমবারে রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভয়ের গাড়ির উপর হামলার পর আসাদকে ফের এক বার কাঠগড়ায় তোলার সুযোগ পেল পশ্চিমী দেশগুলি। কিন্তু রাসায়নিক হানার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ঐকমত্যে পৌঁছনোর সম্ভাবনা প্রায় নেই। তাই এই সুযোগের পরিণতি কী হয়, তার দিকেই তাকিয়ে আন্তর্জাতিক মহল। |