দিল্লির সঙ্গে বিরোধের বিরাম নেই। কেন্দ্র-রাজ্য টানাপোড়েনের সেই সম্পর্কে এ বার নতুন সংযোজন গঙ্গা-পদ্মার ভাঙন।
দুই নদীর ভাঙনের গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার বিস্তীর্ণ আবাদি জমি। বর্ষায় ফরাক্কায় গঙ্গার জলস্তর বাড়লে ভাঙনের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। বানভাসি হওয়ার খাঁড়া ঝুলছে বিস্তীর্ণ এলাকার উপরে। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করে তিন মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সেই চিঠির আনুষ্ঠানিক প্রাপ্তি-স্বীকার ছাড়া অবশ্য আর কোনও জবাব মেলেনি। পাশাপাশি, ক্রমান্বয়ে দুই জেলায় বেড়েছে ভাঙনের গতি। নদীগর্ভে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে গোটা গ্রাম। কোথাও বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকি তলিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয়টিকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অভিযোগ, কেন্দ্রের তাতেও হুঁশ ফেরেনি।
জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ভাঙনের কথা স্বীকার করে নিয়েও জানাচ্ছে, যথেষ্ট অর্থের অভাবেই ভাঙন প্রতিরোধের কাজ করা যাচ্ছে না। রাজকোষের ঘাটতি সামলাতে অর্থ মন্ত্রক খরচে লাগাম টেনেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী সপ্তাহে রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিল্লি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা। রাজীববাবু নিজেও জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি রাজধানীতে এসে ধর্নায় বসবেন।
মনমোহন-সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ নতুন নয়। এত দিন অবশ্য কেন্দ্রের তরফে সেই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু এ বার, গঙ্গা-পদ্মার ভাঙনে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ভয়াবহ অবস্থার কথা এড়িয়ে যেতে পারছে না নয়াদিল্লিও। জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের বক্তব্য, ১৯৭৫ সালে চালু হওয়া ফরাক্কা ব্যারেজের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভাগীরথী-হুগলি নদীতে জল ছেড়ে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা। তার জন্য প্রতি বছরই বাজেটে অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি ব্যারেজের উজানে ৪০ কিলোমিটার এবং ভাটিতে ৮০ কিলোমিটার অংশে ভাঙন এবং ভূমিক্ষয় রোধের দায়িত্বও যে কেন্দ্রেরই ছিল, তা মেনে নিয়েছে দিল্লি।
ভাঙন-রোধে জলসম্পদ মন্ত্রকের অধীনস্থ ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ যে অর্থ বরাদ্দ করে, তা যথেষ্ট নয়। ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের দিকে তোলা রাজ্যের এই অভিযোগ কার্যত মেনে নিয়েছেন ব্যারাজ প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার অরুণকুমার সিংহ নিজেও। তিনি স্বীকার করছেন, “আমাদের যে তহবিল রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। ভাঙন প্রতিরোধের কাজ তাই করতে পারছি না।’’ জলসম্পদ মন্ত্রকের হিসেব বলছে, তিন বছরে দশ কিলোমিটার অংশেও ভাঙন রোধে কাজ হয়নি।
বর্ষার আগেই প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে মমতা জানিয়েছিলেন, মালদহের ভুতনিদিয়ারা, দোমহাট, শিমুলতলা থেকে মুর্শিদাবাদের হোসেনপুর, ইসলামপুর, হাসানপুর, বয়রা, ময়া, নাড়ুখাকি কিংবা বালিয়ার মতো বিভিন্ন এলাকায় লাগামছাড়া ভাঙন চলছে। কিন্তু রাজ্যের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ভাঙন রুখতে ফরাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের বিশেষ হেলদোল চোখে পড়েনি। এ জন্যই, ভাঙন প্রতিরোধ খাতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করার অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছিলেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কা যে অমূলক নয়, গত দু’মাসে মুর্শিদাবাদ ও মালদহের ভাঙন-চিত্রেই তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। গঙ্গার সঙ্গে পদ্মারও জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক দিনে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নাড়ুখাকি, মিথিপুর, ইসলামপুর, কাটাখালি বাজিতপুরের অস্তিত্বই মানচিত্র থেকে মুছে যেতে চলেছে। সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য নাড়ুখাকি গ্রামে বিএসএফের একটি চৌকি ছিল। ভাঙনের ফলে সীমান্ত-চৌকিটির ৪০ মিটারের মধ্যে এসে পড়েছে পদ্মা। ওই চৌকিটি তলিয়ে গেলে সীমান্তে নিরাপত্তা প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়াবে। ওই গ্রামগুলির প্রায় হাজার বারো মানুষের বসত। বিপন্ন তাঁদের ঠিকানাও। পদ্মার গ্রাসে ওই চৌকি হারিয়ে গেলে অরক্ষিত সীমান্তে তাঁরা থাকবেন কী করে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েই। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তরফেও ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে তাই ফরাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পের কর্তাদের অনুরোধ করা হয়েছে। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ এখনও উদ্যোগী না হলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাই বিপন্ন হয়ে পড়বে।” |
রঘুনাথগঞ্জের নাড়ুখাকির চরে পদ্মার ভাঙন। অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। |
জলসম্পদ মন্ত্রকের নীতি অনুযায়ী, ফরাক্কা ব্যারাজ থেকে ভাগীরথী-হুগলিতে জল সরবরাহ করে বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখার জন্য প্রতি বছর অর্থ বরাদ্দ হলেও ভাঙন প্রতিরোধের জন্য নির্দিষ্ট প্রকল্পের ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ হয়। ভাঙন ঠেকাতে কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, তা খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। ফরাক্কা প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার বলেন, “দিল্লিতে জলসম্পদ মন্ত্রকের কাছে একাধিক প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ হয়নি।” জলসম্পদ মন্ত্রক পাল্টা জানাচ্ছে, তারা সেই প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। জলসম্পদ মন্ত্রী হরিশ রাওয়াত নিজেই পশ্চিমবঙ্গে ভাঙন ঠেকানোর জন্য অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দিয়েছেন। সচিব অলোক রাওয়াত এ ব্যাপারে ফরাক্কার জন্য নোট-ও তৈরি করেছেন বলে জানা গিয়েছে। কিন্তু সব চেষ্টাই মুখ থুবড়ে পড়েছে অর্থমন্ত্রকের সামনে। অর্থমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজকোষের ঘাটতি সামলাতে বাজেটের অতিরিক্ত খরচে আর সায় দিচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদরা এখানেই প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অভাব টের পাচ্ছেন। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, প্রণববাবু সরকারে থাকাকালীন ভাঙন-সমস্যার গুরুত্ব বুঝে, মন্ত্রিসভায় নিজের প্রভাব খাটিয়ে অর্থ বরাদ্দ করতেন। কিন্তু এখন মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোনও পূর্ণমন্ত্রী নেই। যার আঁচ পোয়াতে হচ্ছে রাজ্যের ভাঙনগ্রস্ত এলাকার মানুষকে।
মহাকরণের বক্তব্য, নদী ভাঙন ঠেকানোর মতো আর্থিক ক্ষমতা রাজ্যের নেই। তা সত্ত্বেও সম্প্রতি রাজ্য ১৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। তৃণমূল-সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে খরচ হয়েছে অন্তত ২০০ কোটি টাকা। রাজীববাবু বলেন, “যেখানে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন, সেখানে এ ভাবে বেশি দিন চলতে পারে না। দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। প্রয়োজনে আমি ধর্নায় বসব।”
|