কাজ জোটেনি, ঠাঁই মেলেনি বধূ ফিরতে চান যৌনপল্লিতেই
পুণের এক যৌনপল্লির ঘরে ওঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। প্রায় দু’বছর। তার মধ্যে সূর্যের মুখ দেখেননি। নিত্য দিন যৌন অত্যাচার তো ছিলই, বাড়তি হিসেবে মারধর, নিগ্রহ। সিগারেটের ছ্যাঁকায় সারা শরীর দগদগে হয়ে গিয়েছিল।
বিক্রি হয়ে যাওয়া সেই গৃহবধূকে পুলিশ এগারো মাস আগে পুণের নরক থেকে উদ্ধার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেও শ্বশুরবাড়িতে তাঁর স্থান হয়নি। বিভিন্ন তরফে বিবিধ প্রতিশ্রুতি পেলেও জোটেনি কোনও কাজ। বাধ্য হয়ে ফের ওই নরকেই ফিরতে চাইছেন তিনি। বলছেন, “খাওয়া জুটছে না। ওখানে অন্তত প্রাণটা বাঁচবে!”
শুনে পুলিশ অফিসারেরা স্তম্ভিত, যাঁরা কি না প্রাণ বাজি রেখে ওঁকে ফিরিয়ে এনেছেন। ওঁকে আটকে রাখার অভিযোগে দুই মহিলাকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু বধূটি এ বার স্বেচ্ছায় তাদের ডেরায় ফিরে গেলে ধৃতদের বিচার কী ভাবে করা যাবে, সেটাও ভেবে পাচ্ছে না পুলিশ। পাশাপাশি এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে আরও বড় হয়ে উঠেছে যে প্রশ্ন, তা হল: পাচার-চক্রের খপ্পর থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কতটুকু হচ্ছে এ রাজ্যে?
বিষয়টি জানার পরে সরকারের তরফে অবশ্য আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, মহিলা যোগাযোগ করলে তাঁকে হোমে রাখার ব্যবস্থা হবে। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও তাতে উদ্যোগের গাফিলতির দিকটা বিশেষ চাপা পড়ছে না।
বাসন্তীর বাড়ি থেকে পুণের যৌনপল্লিতে গিয়ে উঠলেন কী ভাবে?

ধৃত মালকিনরা। সরস্বতী থাপা (সামনে)
ও সহেলি তামাঙ্গ। —ফাইল চিত্র
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, দিনমজুর স্বামী শ্বাসজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দু’টি শিশুসন্তান নিয়ে পরিবারটির প্রায় অনাহারে দিন কাটছিল। দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করতে কাজের খোঁজ করছিলেন ওই বধূ। তারই সুযোগ নিয়ে আড়কাঠিরা তাঁকে পাচার করে দেয় বলে অভিযোগ। বছর পঁচিশের মহিলার নিজের কথায়, “দু’টো ছেলে মাঝে-মধ্যে বলত, কলকাতায় বাবুর বাড়িতে কাজের লোকের চাকরি জুটিয়ে দেবে। এক বিকেলে স্বামীর ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিলাম। তখন ওরা আমাকে বলে, কলকাতার বাবুরা এসেছেন। দেখা করাতে ওষুধের দোকানের সামনে থেকে আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গেল।” মহিলার অভিযোগ, বাসস্ট্যান্ডে তাঁকে একটা ঠান্ডা পানীয়ের বোতল দেওয়া হয়েছিল। খেয়েই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। “যখন হুঁশ ফিরল, তখন ট্রেন চলছে। ছেলে দু’টো সামনে বসে।” বলেন তিনি। ছেলে দু’টো পুণের ওই যৌনপল্লিতে তাঁকে বেচে দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন বাসন্তীর বধূটি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠীর বক্তব্য, “ওঁর মা বাসন্তী থানায় নিখোঁজ-ডায়েরি করেছিলেন। ধরা পড়া কিছু আড়কাঠিকে জেরা করে জানা যায়, উনি রয়েছেন পুণের যৌনপল্লিতে।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর অরিন্দম আচার্যের নেতৃত্ব একটি দল বধূর ভাইকে নিয়ে পুণে রওনা হন।
নিখোঁজ মহিলার হদিস পেলেও উদ্ধারের কাজটা মোটেই সহজ হয়নি। বরং কী ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে তাঁরা পড়েছিলেন, তা মনে করে এখনও শিউরে উঠছেন উদ্ধারকারীরা। অরিন্দমবাবুর কথায়, “যৌনপল্লিটিতে শ’চারেক মহিলার বাস। আমরা মহিলার ভাইকে বলেছিলাম, বোনের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে নানা ঘরে ঘুরুন। উনি ঘুরতে থাকেন। একটা ঘর থেকে বোনের সাড়া পাওয়া যায়।” তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে আনেন পুলিশকর্মীরা। জবরদস্তি আটকে রাখার অভিযোগে ধরা হয় যৌনপল্লির দুই কর্ত্রী সোহেলি তামাঙ্গ ও সরস্বতী থাপা (জুলি)- কে।
এর পরেই বিপত্তি। অরিন্দমবাবু বলেন, “স্থানীয় রাজনৈতিক দলের হাজারখানেক লোক আমাদের ঘিরে ধরে। বলে, মালকিনদের ধরা যাবে না। আমাদের উপরে চড়াও হয়ে দু’জনকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। মনে হচ্ছিল, প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না।” পুলিশকর্মীরা জানাচ্ছেন, ক্ষিপ্ত জনতার সামনে সার্ভিস রিভলভার বার করারও উপায় ছিল না। তা হলে রেহাই মিলল কী ভাবে?
“উপস্থিত বুদ্ধির জোরে।” জানাচ্ছেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যেরা। অরিন্দমবাবু বলেন, “ঘটনাচক্রে আমি সে দিন আধা- ফৌজের জংলা উর্দি পরে ছিলাম। প্রাণ বাঁচাতে ওটাকেই কাজে লাগাই। ভাব দেখাই, আমরা যেন প্যারা মিলিটারি। কানে মোবাইল ধরে হিন্দিতে চেঁচিয়ে আরও জওয়ান পাঠানোর নির্দেশ দিতে থাকি।”
অরিন্দমবাবুর বক্তব্য, তাতেই কাজ হয়েছিল। জনতা ধরে নেয়, সাধারণ পুলিশ নয়, আধা-ফৌজ এসেছে। তারা কিছুটা ঘাবড়ে যায়। জনতা একটু পিছু হটতেই তাঁরা তিন মহিলাকে নিয়ে কোনওক্রমে স্থানীয় থানায় চলে আসেন বলে জানিয়েছেন অরিন্দমবাবু। পরে সকলকে কলকাতায় আনা হয়। পুলিশের দাবি, বাসন্তীর গৃহবধূকে আশি হাজার টাকায় ওই দুই মহিলার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল।
যৌনপল্লির দুই মালকিনের ঠাঁইহয়েছে আলিপুর সংশোধনাগারে। কিন্তু যৌনপল্লির ‘ছাপ্পা’ লাগায় বৌয়ের ঠাঁই হয়নি শ্বশুরবাড়িতে। আপাতত তিনি মায়ের আশ্রয়ে। দুই বাচ্চাকে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মারফত হোমে ভর্তি করে দিয়েছেন পুলিশের কর্তারা। কিন্তু বধূটির এখন নিজের পেট চালানোই দায়। জানান, একমাত্র ভাই সামান্য কাজ করেন। মায়ের সংসারে তিনি বোঝা। তাঁর বক্তব্য, “সবার কাছে একটা কাজ চাইছি। কেউ দিচ্ছে না। পুলিশবাবুরা নানা ভাবে সাহায্য করছেন। কিন্তু ওঁরাই বা কত দিন করবেন?”
অগত্যা পুণের ওই নিষিদ্ধপল্লির ঘুপচি ঘরেই ফিরে যাওয়া মনস্থ করেছেন তিনি। “শত অত্যাচার হলেও দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তো পাব।” অদ্ভুত নিরাসক্ত গলায় বলছেন ‘নরক’ দেখে আসা গৃহবধূ। রাজ্য সরকারের কিছু করার নেই?
পুরো বিষয়টি শুনে রাজ্যের নারী-সমাজকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র রবিবার বলেন, “মহিলা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা ওঁকে কোনও হোমে রাখার ব্যবস্থা করব।” ওঁর মতো উদ্ধার হওয়া মেয়েদের পরিবার বা শ্বশুরবাড়ি যাতে ফিরিয়ে দিতে না-পারে, সে জন্য সরকার একটি আইন তৈরির কথাও ভাবছে বলে এ দিন জানিয়েছেন মন্ত্রী।
অন্য দিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সামসুল আলম এ দিন বলেন, “এমন কেউ আমাদের কাছে এলে প্রাথমিক ভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করি।
পরে তাঁকে সরকারি বা বেসরকারি হোমের সঙ্গে যোগাযোগও করিয়ে দিই। বাসন্তীর এই মহিলা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দেখব, উনি যাতে সমাজে সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারেন।”
ওঁর দুর্গতির কথা না হয় সরকার বা স্বেচ্ছাসেবীর গোচরে আনা হয়েছে। ওঁর মতো আরও কত জন একই ভাবে ফের নরকমুখী হয়েছেন বা হচ্ছেন, তার হিসাব কেউ রাখছে?
প্রশাসনের তরফে অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.