|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
বিবর্ণ, ক্ষয়াটে মুখমণ্ডলে পমেটম মাখছে দুয়োরাজা |
বৃষ্টি বাড়ে, জলও বাড়তে থাকে গঙ্গার পশ্চিম পারের এ শহরে। ডুবে যায় শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। অসহায়
দিন কাটান মানুষজন। পাঁচশো বছরের পুরনো শহরটায় ফি-বছর একই জলচিত্র। তাতে নদীর এ
পারের গর্বিত মেট্রোপলিস-এর কী এসে গেল? ডুবজল হাওড়ার কথা লিখছেন
তাপস সিংহ |
সারা বছর উঠোনের কোণে ইটের পাঁজাটা ঘাঁটি গেড়ে থাকে। বর্ষার দিনগুলোয় ওদের ভীষণ চাহিদা। মেঘ ঘনিয়ে আসে, বৃষ্টি নামে, পাঁজা থেকে ইট নামে, বাড়ির সামনে লক্ষ্মীর পা আঁকার মতো ইটের আলপনা দেওয়া শুরু হয়। বর্ষা-বরণ। হাওড়ায়।
বৃষ্টি বাড়ে, জলও বাড়তে থাকে গঙ্গার পশ্চিম পারের এ শহরে। জল জমে বেলিলিয়াস রোডে, বেলিলিয়াস লেনে, পঞ্চাননতলা রোডে, কৈলাস ব্যানার্জি লেনে। ডুবে যায় হাওড়া পুর এলাকার সমস্ত নিচু এলাকা। ডুবে যায় শহরের ‘লাইফলাইন’ জিটি রোড, এ ছাড়া পূর্বপাড়া এলাকা, পেয়ারাবাগান, বালিটিকুরি, বেলগাছিয়া, নস্করপাড়া, ঘোষপাড়া, মহীনাথ পোড়েল লেনের মতো অজস্র জায়গা। জলভাসি হয় বালি ও লিলুয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অসহায় দিন কাটান হাওড়া পুরসভার সংযোজিত এলাকার মানুষজন। বছরের পর বছর।
নামগুলো কেমন অচেনা-অজানা লাগে, না? যাঁরা ওই সব অঞ্চলে থাকেন না, গঙ্গা পেরিয়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরা ছাড়া ‘হাওড়া’ শব্দটার সঙ্গে যাঁদের আর তেমন কোনও যোগাযোগ নেই, ওই সব নামে তাঁদের আগ্রহ জন্মাবে না। কিন্তু যাঁদের গঙ্গার পশ্চিম পারেই থাকতে হয়, কাজকর্ম, পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে এ পারে আসার উপায় যাঁদের নেই, তেমন কোনও অভিপ্রায়ও নেই, তাঁরা কী করবেন?
তাই বর্ষার মেঘে যখন আরও ঘোর লাগে, মাতাল বৃষ্টি যখন ‘কুলি টাউন’-এর আনাচকানাচ, গলিঘুঁজি, এঁদো পুকুর ভাসিয়ে দেয়, তখন ইটের পাঁজা থেকে আরও ইট নামে। উনুন, গ্যাস সিলিন্ডার, সুটকেস, তোরঙ্গ, পড়ার টেবিল, খাট, আলমারি উঁচু হতে থাকে। তাতেও যখন লড়াইটা অসম হয়ে ওঠে, ঘরে জল ঢুকে আলমারির নীচের তাক ভাসিয়ে দ্বিতীয় তাকে ওঠে, গ্যাস সিলিন্ডার প্রায় ডুবে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায় রান্না, বহু মানুষকে তখন ঘর ছাড়তে হয়। গয়নাগাটি, টাকাপয়সা, মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে যেতে হয় আশপাশের অথবা দূর এলাকার উঁচু জায়গায় থাকা স্বজনদের আশ্রয়ে। |
|
‘কুলি টাউন’। বেলগাছিয়া, হাওড়া, ২১ অগস্ট। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার |
হ্যাঁ, পাঁচশো বছরের দুয়োরানি শহরটায় ফি-বছর এটাই জল-চিত্র। নিষ্ফল হতাশায় হাওড়ার মানুষ বলেন, এ তাঁদের ভবিতব্য। বলেন, এ তো কলকাতা নয় যে পুলিশ-প্রশাসন ঝাঁপিয়ে পড়বে! সরকারের শীর্ষস্তর থেকে পরিস্থিতির উপর নজরদারি থাকবে! এটা হাওড়া। কলকাতা লন্ডন হলে হাওড়ার কী আসে-যায়?
কিন্তু এখনও কি সে কথা বলা যায়? হাওড়ার কি সত্যিই এ বার কিছু যাবে-আসবে না?
কিছু দিন পরেই তো রাজ্য প্রশাসনের ক্ষমতার কেন্দ্র মহাকরণের নতুন ঠিকানা হবে হাওড়া। মন্দিরতলায় এইচ আর বি সি ভবনে সাময়িক ভাবে চলে যাবে মহাকরণ। সেই ভবনের সামনের রাস্তা, ক্ষেত্র ব্যানার্জি লেনও সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ভেসে গেল! তবে ভবিষ্যতে যাতে ওখানে জল আর না জমে, সে জন্য তৎপরতা এখন তুঙ্গে। সাময়িক হোক, রাজবাড়ি বলে কথা।
এই তৎপরতা স্বাভাবিক। যুক্তিসংগতও বটে। যেখানে আর কিছু দিনের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী-সহ রাজ্য প্রশাসনের তাবড় কর্তাব্যক্তি নিত্য যাতায়াত করবেন, সেই জায়গা অবশ্যই বাড়তি গুরুত্ব দাবি করে। কিন্তু, যে রাস্তায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ ভাবে যাবেন না, সেই রাস্তা কি বরাবর থেকে যাবে নজরের আড়ালে?
এক বার যদি প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা হাওড়া শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বেলিলিয়াস রোডে পা রাখতেন, দেখতেন, নিকাশির উন্নতির জন্য ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া একটি প্রকল্প আজও শেষ হল না। অথচ, ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১১-র মার্চের মধ্যে। এই রাস্তায় ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপ বসানোর কাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়ায় এখনও আটকে রয়েছে বেলিলিয়াস রোড। বন্ধ হয়ে রয়েছে বাস চলাচল। ঢুকতে পারে না বড় অ্যাম্বুল্যান্স, দমকলের গাড়ি।
বিলম্বিত এই প্রকল্প আসলে এক প্রতীক— অবহেলার, গুরুত্বহীনতার, বঞ্চনার। হাওড়ার মানুষজন মনে করেন, বিশ্বাস করেন, চিরকাল এই শহরের নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ছেলেখেলা হয়েছে। স্রেফ কিছু শপিং মল তৈরি করে বা মেট্রো রেল প্রকল্প এনেও ‘কুলি টাউন’-এর প্রতি ‘শহুরে’ কলকাতার নাকউঁচু মনোভাবের কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। মহাকরণের কর্তাগিন্নিরা কিছু দিন বাসা বদলালে সে মনোভাব বদলাবে, এতখানি দুরাশা হাওড়ার নেই।
শাসক পরিবর্তনের পরে কলকাতাকে লন্ডন বানানোর কথা শুনে হাওড়াবাসী বলতেন, লন্ডন নয়, আমাদের কলকাতা বানিয়ে দিলেই চলবে। আর সাম্প্রতিক বর্ষণে জলবন্দি হাওড়া কী বলছে? কয়েক দিন আগে এই পত্রিকায় প্রকাশিত কলকাতার পাতিপুকুর আন্ডারপাসের একটি ছবির কথা মনে করিয়ে দিয়ে মধ্য হাওড়ার এক চিকিৎসকের মন্তব্য: ‘আমাদের পঞ্চাননতলা আর ওদের পাতিপুকুর— আমরা এখন এক। বেশ আছি!’
বেশ আছে হাওড়া! মাঝখানে নদী ওই... ও পারে সুয়োরাজাকে কিছু দিনের জন্য ছেড়ে রানি আসবেন দুয়োরাজার এই মহলে! স্বপ্নহীন চোখ, বিবর্ণ, ক্ষয়াটে মুখমণ্ডলে তাই পমেটম মাখছে গঙ্গার পশ্চিম কূল!
দুয়ারের বাইরে লক্ষ্মীর পায়ের মতো ইটের আলপনা! |
|
|
|
|
|