ইসলামের সঙ্গে কি গণতন্ত্রের কোনও গভীর বিরোধ আছে? প্রশ্নটি নূতন নহে, নূতন পরিস্থিতির চাপে নূতন করিয়া সামনে উঠিয়া আসিতেছে। বলা হইতেছে, গত দেড় মাস যাবৎ মিশরে যে তুমুল তাণ্ডব চলিতেছে, তাহা ‘ঘটনাচক্র’ নহে, বরং অনিবার্য ‘ঘটনা-ক্রম’। অনিবার্য, কারণ ইসলাম ও গণতন্ত্র তেল ও জলের ন্যায়। দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর মুসলিম ব্রাদারহুড দলের মহম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হইয়া প্রবল কর্তৃত্ববাদী ভঙ্গিতে মিশরীয় সমাজের উপর ইসলামি বিধি-বিধান যে ভাবে প্রতিষ্ঠা করিতেছিলেন, তাহা গণতন্ত্রবিরোধী ছিল, সেই জন্যই তাঁহাকে দেশের সামরিক শক্তির হস্তক্ষেপে সরিয়া যাইতে হইল: ইহাই যুক্তি। অর্থাৎ, যে সামরিক অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের বিশেষ প্রতিবন্ধক, ইসলামি গণতন্ত্রের নিজস্ব চলনই তাহাকে অনিবার্য ভাবে আহ্বান করিয়া আনিল। তুরস্ক এবং টিউনিসিয়ার দৃষ্টান্তও গণতন্ত্র ও ইসলামের এই বিরোধিতার স্বাক্ষর বলিয়া পশ্চিমি গণমাধ্যমের একাংশের দাবি।
এই তিন দৃষ্টান্তের মধ্যে একটি গুরুতর সাদৃশ্য আছে। তুরস্কে কিছু আগে, এবং টিউনিসিয়া ও মিশরে ‘আরব বসন্ত’কালে মানুষ যে ভাবে কর্তৃত্ববাদ বা একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসিয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রস্ফুটনের মধ্য দিয়া সাফল্যমণ্ডিত হয় নাই, গণতন্ত্র পথ হারাইয়াছে। তবে এই যুক্তি যাঁহারা দেন, তাঁহাদের উদ্দেশে একটি সতর্কবার্তা জরুরি। ইসলামি দেশগুলিতে গণতন্ত্র অসম্ভব— ইহা না বলিয়া তাঁহাদের বলা উচিত: ইসলামি দেশগুলিতে যখন রাজনৈতিক ইসলামের মাধ্যমে গণতন্ত্রে পৌঁছাইবার চেষ্টা করা হয়, তখনই সাফল্যের আশা কম। লক্ষণীয়, তুরস্ক, মিশর, টিউনিশিয়া, প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামি দলগুলিই নির্বাচনে জয়ী হইয়া সরকার গঠন করিয়াছে, এবং অবধারিত ভাবে, নির্বাচনী পর্ব শেষ হইলেই গণতন্ত্রের পুস্তিকা দ্রুত বন্ধ করিয়া কর্তৃত্ববাদের কেতাবটি খুলিয়া ফেলিয়াছে। তাহার পর যাহা ঘটিবার, ঘটিয়াছে। কিন্তু একটি কথা থাকিয়াই যায়। আরব দেশগুলিতে যদি নির্বাচনে রাজনৈতিক ইসলামের ভাবাদর্শের বদলে অন্য কোনও মধ্যপন্থী আদর্শ জয়ী হইত, তবে হয়তো কর্তৃত্ববাদের পথ এত সুগম হইত না। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে যে কর্তৃত্ববাদ নিহিত, সমস্যাটি সম্ভবত তাহারই। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ কিন্তু ইহাই দেখাইয়া দিতেছে যে, যদি ইসলাম-অধ্যুষিত দেশে ক্ষমতায় আসে এমন দল, যাহার পরিচয় পুরাদস্তুর ‘ইসলামি’ নহে, তবে গণতন্ত্রের পথে কিছুটা অগ্রগতি সম্ভব।
সত্যই কি ইসলামি দেশে কখনওই অ-ইসলামি দলের পক্ষে নির্বাচনে জিতিয়া দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসা সম্ভব? পুরাদস্তুর রাজনৈতিক ইসলাম না হইলেও পাকিস্তান বা বাংলাদেশের প্রধান দলগুলি ইসলামের ছত্রছায়াতেই বিকশিত নয় কি? সেই ছত্রটি থাকে বলিয়াই কি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বিকাশ সেখানে ব্যাহত হয় না? জটিল প্রশ্ন। এইটুকু বলা যায়, গণতন্ত্রের পথটিকেও সাদা-কালোয় দেখা উচিত নহে। এই পথেরও অনেক ধাপ, অনেক বাঁক। এক এক সমাজকে এই পথ এক এক ভাবে পার হইতে হয়। লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে তো ইসলামি প্রাধান্য নাই, তাহাদেরও এই পথে চলা কষ্টসাধ্য হইয়াছে। ইসলামি দেশগুলিকেও উত্থানপতনের মধ্য দিয়াই যাইতে হইবে, কিন্তু সেই যাত্রা যে ব্যর্থতাতেই শেষ হইবে, এতখানি বলিবার কারণ এখনও ঘটে নাই। আপাতত এক দিকে সেনাবাহিনী, অন্য দিকে রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে পিষ্ট হইতেছে মিশর। কিন্তু ইহাই নিশ্চয় তাহার শেষ ভবিতব্য নয়! তহরির স্কোয়ার-এর পথটিই কি আর প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক-এর আমলে ভাবিতে পারা গিয়াছিল? |