রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
একটাভয়[কষ্ট]লজ্জাঘেন্না
পুজো শেষ হতে না হতেই আমাদের বাড়িতে ধুম লেগে যেত। দেশের বাড়ির কালীপুজোয় যাওয়ার হইহল্লা। রোজ সন্ধে থেকে উচ্চৈঃস্বরে লিস্টি চলত, এ বার পুজোয় কে কে যাবে, কবে থেকে যাবে, বাবা কবে অফিস থেকে ছুটি পাবে। কিন্তু যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত কেউই ঠিকঠাক জানত না, কে সক্কাল সক্কাল হাওড়ায় বড় ঘড়ির তলায় দাঁড়াবে, আর কাটোয়ার দিকের ট্রেনে সবার কী করে যেন দেখা হয়ে যাবে আর জানা যাবে সবাই আমাদের দেশের কালীপুজোতেই যাচ্ছে! শেষে কাটোয়া স্টেশনে নামবে জনা কুড়ির দল, মুড়ি আর বোঁদে কিনবে, আর গঙ্গার চিকচিকে জলে ছেড়ে দেবে আমাদের সোনার কাঠের তরী। এই সুখ-সুখ ভূমিকার আবহে, আজকের আসল গল্প।
আমার জ্যাঠা ডাক্তার। গ্রামে পা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে লোক ছুটে আসবে তেনারে পেন্নাম করতে। তিনি ওদের ভগবান। এক সময় জ্যাঠা ওদের বিনা পয়সায় অনেক চিকিৎসা করেছেন। জ্যাঠার সঙ্গে তাদের চলবে অনেক গপ্পো, ঝুড়িতে আসবে গাছের বেগুন, কুমড়ো, লাউ, পুকুরের মাছ। এরই মধ্যে বুড়ি মহিলা আসবে ডাক্তারবাবুকে দেখাতে। কেউ আসবে রেফারেন্স নিতে, কেউ আবার শুনতে চাইবে সেই রোমহর্ষক কাহিনি, যেখানে সবাই ভেবেছিল লোকটা কিছুতেই বাঁচবে না, আর জ্যাঠা বললেন, সরো দেখি, আমায় নাড়ি দেখতে দাও!
সকালেই ঠাকুর ঘামতেল মেখে পাটাতনে উঠতে তৈরি। মা চলে গেছে ভোগের ঘরে। আমরা গঙ্গায় চান করে এসেছি। বিকেল গড়িয়ে রাত আসছে। আমরা মোমবাতি জ্বালাব বলে ছাদে গিয়েছি। বাবা তারাকাঠি, ইলেকট্রিক তার, চরকি, রংমশাল গুছিয়ে রাখছে বারান্দার পাশে। গ্রামের রক্ষাকালীতলায় আমাদের বাড়ির প্রথম পুজো গিয়েছে। এমন সময় বেশ কয়েক জন লোক পাগলের মতো দৌড়ে এল জ্যাঠার কাছে। এক জন বছর তিরিশের ছেলে খুব ছটফট করছে আর অদ্ভুত ভাবে গোঙাচ্ছে। এক জন বয়স্ক লোক কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘ও ডাক্তারবাবু, ফলিডল খেয়েছে গো, ফলিডল খেয়েছে। ওর বউটা কী ঝগড়াই করল! ওর মা কত বললে, ও পোড়ারমুখী এ বার চুপ দে। পুজোর দিন ছেলেটাকে আর বলিস না। শুনলে না গো। সন্ধেয় দেখি মুখে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।’ জ্যাঠা এতটুকু দেরি না করে মা’কে বলল, ‘বউমা, তেঁতুল গুলে আনো আর কাঁচা ডিম ভাঙো।’ বমি করিয়ে পেট ওয়াশ করার গ্রামে এর চেয়ে ভাল উপায় তখন হাতে নেই।
তাই করা হল। ছেলেটা অনেক বমি করল। তবু অত বড় তাগড়া চেহারা মাঝে-মধ্যেই ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। জ্যাঠা পাল্স ধরে সারা ক্ষণ বসে রয়েছে। আরও কী সব ওষুধ দিচ্ছে। আমরা বাজি পোড়াচ্ছি না। মাঝে মাঝে রক্ষাকালী তলায় ডুডু-ডুম ড্যাডাং ড্যাডাং করে ঢাক বেজে উঠছে। সেই শব্দে আমার ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করছে। ছেলেটার সঙ্গের লোকেরা থেকে থেকেই চেঁচিয়ে উঠছে, ‘হে মা কালী আজ ছেলেটাকে খেয়ে নিস না মা!’ আমার ভেতরটা ছমছম করছে।
কিছু ক্ষণ পর জ্যাঠা গম্ভীর মুখে ওদের বলল, তোমরা বরং ওকে কাটোয়া হাসপাতালে নিয়ে যাও। তখন ছেলেটা বড্ড ছটফট করছে। সবাই যখন পাঁজাকোলা করে ওকে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে জ্যাঠার দিকে তাকিয়ে গোঙাচ্ছে আর বলছে, ‘অই ডাক্তার, আমি মরতে চাই নে রে, আর খাব নাই রে ফলিডল। তু এই বারটা বাঁচাই লে ক্যানে। আমি মরব নাই রে আমি মরব নাই, আমায় যেতে দিস না রে।’ জ্যাঠা গম্ভীর মুখে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বারান্দায়। মৃত্যু কী আমি তখন বুঝতে শিখেছি। আমার খালি মনে হচ্ছিল, তা হলে ওই ছেলেটা আর কোনও দিন কালীপুজো দেখতে পাবে না, কোনও দিন গঙ্গায় সাঁতার কাটবে না, কোনও দিন চাষের জমিতে যাবে না, কোনও দিন ভাত খাবে না! আর ছেলেটাও কি এখন সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে!
রক্ষাকালীতলায় তখন ঢাকে সেই বোলটা বাজছে। এ বার বলির পালা। কান ফাটানো ম্যাহ্যাহ্যা ম্যাহ্যাহ্যা চিৎকার। বোধ হয় মুখে বেলপাতা ঠুসে দেওয়া হল। হাড়িকাঠ তৈরি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.