|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: নিশীথে-র
|
রানা সেনগুপ্ত |
বরানগরে সাইকায়াট্রিস্ট সেজে অপেক্ষায় আছি। নাম ফাটলো। কারণ, ভাড়া-করা মনোরোগীরা আসে, আর লহমায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে! শেষে তিনি ধরা দিলেন। নামটা পুরনো আমলের। দক্ষিণাচরণ। সর্বত্র নিজেকে ডি সি বলে বিজ্ঞাপিত করেন। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন জমিদার। এখন জমিদারি নেই। ঠাটবাট আছে। চেম্বারে এসে গম্ভীর গলায় বললেন, আমার এই রোগের কথা কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। আমি হেসে বললাম, এটাই তো মেডিকাল এথিক্স। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! ডি সি বললেন, সব সময় একটা ভয়ের ভেতর রয়েছি। মনে হয়, আমার বিছানার পাশে প্রতি রাতে এক জন দাঁড়িয়ে থাকে। বার বার আমার শয্যাসঙ্গিনীর দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রশ্ন করে, ও কে, ও কে গো! সারা রাত ঘুমোতে পারি না। বললাম, এই মানসিক বিকার আসে জীবনের লুকিয়ে থাকা ঘটনা থেকে। সেগুলো খুলে বলুন। দুটো গবলেটে হুইস্কি ঢেলে নিলাম। পেটে হুইস্কি পড়লে প্রায় সকলেই মন খুলে কথা বলতে পারে। আমারও তদন্তের খুব সুবিধা হয়। প্রথম দিন চার পেগ হুইস্কি গিলেও ডি সি মন খুললেন না। আমার তাড়াহুড়ো ছিল না। গভীর জলের মাছ বঁড়শি গেলার আগে শিকারিকে প্রচুর খেলায়! |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
কয়েকটা দিন কেটে গিয়েছে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আমার চেম্বারে আসেন ডি সি। চলে মদের ফোয়ারা। আজেবাজে বকে তিনি বিদায় নেন। ওঁর কথাগুলোকে গোপনে টেপ করি। বার বার চালিয়ে দেখি চিকিৎসার (আসলে তদন্তের) কোনও সূত্র মেলে কি না। কিছুই মিলছিল না। শেষে এল সেই ঝড়বৃষ্টির রাতটা। ডি সি চেম্বারে আসতেই ওঁকে নিয়ে এলাম আমার বাসায়। বরানগরের গঙ্গাপাড়ে একটা হিম-নির্জন বাড়ি। একটা দু’লিটারের হুইস্কির বোতল খুলে বসলাম। সঙ্গে গাঁজা ভরা সিগারেট। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। ডি সি বললেন, আপনি আমার প্রথম স্ত্রীকে দেখেননি। জেনে রাখুন, তাঁর মতো স্ত্রী মানুষ ভাগ্য করে পায়। আমি লুচ্চা চরিত্রহীন বদমাইশ হলে কী হবে, ও আমার কাছে এলে, আমার মনে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠত। মদে চুর হয়ে থাকতাম, নেশার ঘোরে কত মেয়ের নাম ধরে ডাকতাম। কিন্তু এ সবে ও কোনও কৌতূহল দেখাত না। আমার মোবাইল বা মানিব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করত না। তার উপর আমার স্ত্রী বিনতা, বাপের বাড়ি থেকে আমার জন্য প্রচুর ডাউরি এনেছিল। তত দিনে জমিদারি লাটে। ওর গয়না বেচেই ঠাটবাট রেখেছিলাম। একটা কথাও না বলে, ও আমার হাতে তুলে দিয়েছিল আমার শ্বশুরমশাইয়ের ওকে দান করা সাতাশ একরের ল্যান্ডটা। ওটার ওপরেই উত্তর কলকাতার সবচেয়ে পশ কমপ্লেক্সটা গড়ে উঠেছে। তবু অফুরন্ত টাকার দরকার। নতুন নতুন মেয়েছেলে চাই। আমি প্রস্টিটিউটদের সঙ্গে শোওয়া পছন্দ করিনা। ভদ্রঘরের মেয়ে-বউকে বিধ্বস্ত করাতেই আমার আনন্দ। তাদের আমার সঙ্গে শোওয়াতে ওদের পরিবারের লোকেদের মোটা টাকার টোপ দিতে হচ্ছিল। আমার কুবেরের সম্পত্তিও ফুরিয়ে আসছিল! টাকা রোজগারের সবচেয়ে সহজ উপায় কী জানেন ডাক্তার? প্রেমের অ্যাক্টিং করে ভুলিয়েভালিয়ে বড়লোকের একমাত্র, পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলা। আর তার পরে শ্বশুরকে নিংড়ে নিতে কত ক্ষণ! সম্মানের ভয়ে এই পরিবারের লোকেরা থানা-পুলিশও করে না। তত দিনে আমি ইলাহাবাদে গিয়েছি সস্ত্রীক হাওয়া-বদলে। সেখানেই দেখলাম মনোরমাকে। আহা! একুশের মেয়েটার বুকের মাপ ৩৬! তার চেয়েও বড় কথা, ডাক্তার-বাপের সম্পত্তিও বিপুল। আমি ঠিক করে ফেললাম, কিছুতেই মনোকে ছাড়া হবে না। বাসায় এনে বিনতার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। বিনতা মনোকে দেখে চমকে উঠেছিল। কিছু সন্দেহ করেছিল কি? আমার হাতটা চেপে ধরে বলেছিল, ও কে? ও কে গো! আমি বললাম, ও তো ডাক্তারবাবুর মেয়ে। তোমার সঙ্গে গল্প করতে এসেছে। ইলাহাবাদের প্রবাসী মনো ছলাকলার কিছুই জানত না। ওদের বাড়িতে বন্ধু সেজে যাতায়াতের ফাঁকে মনোকে গেঁথে ফেললাম। পাগল-প্রেমের অভিনয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেলাম। কিছু দিনের ভেতরই মনোর গর্ভে আমার সন্তান! হাঃ হাঃ হাঃ! হারান ডাক্তার তো কেঁদেকেটে আমার পায়ে পড়ে বলল, আমাদের সমাজ রয়েছে। ওকে বিয়ে করে মানসম্মান বাঁচাও। যা চাইবে তাই দেব। হারান ডাক্তারকে নিয়ে ছক কষলাম। এক রাতে ডাক্তার ধরল পা, মনো হাত দুটো। আর আমি বিনতার মুখে প্রাণপণে বালিশ চেপে ধরলাম। মনো ইন হলে তো বিনতাকে আউট হতেই হয়! বিনতা নিথর হতে ডাক্তারকে বললাম, নিজের মেয়ের ভাল চাইলে, একটা নর্মাল ডেথ সার্টিফিকেট দিন। কাঁপতে-কাঁপতে হারান সেটা লিখে দিল। বিনতার সৎকার আর মনোরমার পাণিগ্রহণ, এক মাসের ব্যবধানে সেরে ফেললাম। বিনতার মা এসেছিলেন। তত দিনে তিনি পথের ভিখারি। মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে, আচমকা হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন। সব ঠিক চলছিল। ইলাহাবাদেই এক রাতে গঙ্গায় বোটে ঘুরছি মনোরমার সঙ্গে। চারি দিকে জ্যোৎস্না খেলা করছে। চাঁদের আলোয় নেশাগ্রস্ত হয়ে মনোরমাকে চেপে ধরে চুমু খাচ্ছি, এমন সময় বোটের ছাদে কে বলল, ‘ও কে, ও কে গো!’ তার পরেই একটা খলখল হাসি পৃথিবী এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। আমার মনে হল, বিনতাই বোটের ছাদে দাঁড়িয়ে। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। এমন ঘটনা বারে বারে ঘটতে লাগল। বিনতার ভয়ে ইলাহাবাদ থেকে কলকাতায় পালিয়ে এলাম। তাতেও রেহাই নেই! কোনও মেয়েছেলের ঘনিষ্ঠ হলেই, ঘরের অন্ধকার কোণ, আকাশ বাতাস থেকে ভেসে আসে, ও কে, ও কে গো! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমাকে বাঁচান ডাক্তার!
আমার হাত দুটোকে জড়িয়ে ধরলেন ডি সি! ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম, আমি আসলে ডাক্তার নই। ডিটেকটিভ। ডিটেকটিভ পাঁচুগোপাল পাকড়াশির নাম শুনেছেন? আমিই সেই পাকড়াশি। একটা ভুল করেছিলেন দক্ষিণাচরণবাবু। যত অসহায় বিনতার মাকে ভেবেছিলেন, উনি ততটা অসহায় ছিলেন না। ওঁর বাপের বাড়ির লোকেরাও নামজাদা বড়লোক। তাঁরা বিনতার মৃত্যু রহস্যের সমাধান চেয়েছিলেন। আমাকে মোটা ফি দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন তাঁরা। এই টেপ রেকর্ডারে আপনার স্টেটমেন্ট রেকর্ড করা রয়েছে। বরানগর থানার ওসি-ও পর্দার আড়ালে বসে সমস্তটা শুনেছেন। আসুন, ওসি স্যর, আসুন। আমার কাজ শেষ। আপনারটা শুরু। |
|
|
|
|
|