বাবাই এখন ক্লাস এইটে পড়ে। ইস্কুলের বইখাতা, গৃহশিক্ষক, মা, ইস্কুলের স্বপনবাবু, সঞ্জীববাবু সবাই ওর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। ছোটবেলায় নতুন বইখাতা এলেই পাতার ভাঁজে নাক গুঁজে ও গন্ধ শুঁকত। সেই মোহ এখন কেটেছে। জীবনবিজ্ঞানের সাপ, ব্যাঙ সবই এখন বিভীষিকা। তার ভাল লাগে না পড়তে। সব আগ্রহ যেন হারিয়ে ফেলে। বাবাইয়ের খালি মনে হয়, ছোটবেলায় মা হাতে ধরে যে এ-বি-
সি-ডি লেখাত, সেগুলোই ভাল ছিল। বাবাইয়ের বোন বৃষ্টি যখন রাইমস বলে মজা পায়, আর শেষে সব ঠিক বলার আনন্দে হাততালি দিয়ে খিলখিলিয়ে ওঠে, তখন অমনি মা ওকে বুকে টেনে নেয়। বলে, ‘দারুণ বলেছ।’ বাবাইয়ের রাগ হয়। ও কাউকে কিছু বলতে পারে না। মা তো ওকে ওভাবে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে না! খালি বকে, বলে, ‘পাজি ছেলে, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না।’
বাবাই তবু চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিদিনের বকুনি, চোখরাঙানিতে তার পড়াশোনার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মেছে। ছোটবেলায় কিন্তু ও ভালই নম্বর পেত। ইদানীং যেন পিছিয়ে পড়ছে। ভাবে, সবাই বুঝি এগিয়ে গেল। রাতে স্বপ্নে বাবাই কত যুদ্ধ দেখে। দেখে তলোয়ার নিয়ে সে যুদ্ধ করছে ইস্কুলের স্বপনবাবুর সঙ্গে। কখনও বা স্বপ্নে দেখে, মার্কশিটে প্রতিটি বিষয়েই তার প্রাপ্ত নম্বর শূন্য। বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার। বাবাই ভয় পেয়ে বাড়িতে পড়ার সময় বাড়িয়ে দেয়। দুলে দুলে কিংবা পায়চারি করে কত পড়ে সে, তবু কিছুতেই কিছু হয় না।
সে দিন রাতে কত কসরত করে মুখস্থ করল, একটি কাঁটাযুক্ত গাছের নাম ফণীমনসা। পরের দিন ইস্কুলে সঞ্জীববাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল তো সন্দীপন, একটা কাঁটাযুক্ত গাছের নাম?’
বাবাই তথা সন্দীপন মাথা চুলকে ভাবল কিছুক্ষণ। দাঁড়িয়ে দেখল পাশের সবাই হাত তুলে আছে। অর্থাৎ, এই উত্তরটা ও ছাড়া সকলেই পারবে। বাবাই ভাবছে, ‘ইস, এই সহজ প্রশ্নের উত্তরটা...’ ওর মাথায় তখন খালি ‘মনসা’ঠাকুরের নাম ঘুরছে। বলল, ‘স্যর, পেটে আসছে, মুখে আসছে না।’ যা হোক, উত্তরটা বাবাইয়ের মুখ থেকে সত্যিই আর বেরোল না। সৌম্য দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যর, ওটা তো ফণীমনসা।’ বাবাই ভাবল, ‘ইস, মনসার সামনে যদি ফণীবাবুর নামটা বসিয়ে দিতুম!’ |
যা-ই হোক, ফণীমনসার কাঁটা বাবাইয়ের জীবনে কাঁটা হয়ে দাঁড়াল। হল গার্জেন কল। স্যর বাবাইয়ের মাকে অনেক অভিযোগ জানালেন। বাড়ি ফিরে বাবাইয়ের পিঠে পড়ল কয়েক ঘা। ও এ বার বড্ড ভেঙে পড়ল। পাশের বাড়ির সোনালি কাকিমার পরামর্শে পুরনো হেল্থ ড্রিঙ্কস-এর বদলে অন্য একটা হেল্থ ড্রিঙ্কস বাড়িতে এল, যাতে বাবাইয়ের স্মরণশক্তি বাড়ে। বদল হল গৃহশিক্ষক। এলেন নতুন স্যর সুনীলবাবু। বাবাইয়ের কাছে সুনীলবাবু বড় ভাল মানুষ, কারণ তিনি বিন্দুমাত্র বকাবকি করতেন না। বাবাই পড়া না পারলে মাকেও জানাতেন না। তাই কয়েক দিন হল মারধর বাবাইদের বাড়ি থেকে অবসর নিয়েছে। বাবাই সুনীলস্যরের জন্য অপেক্ষা করে থাকত। স্যরের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় কাটাতেই সে বেশি পছন্দ করত। সুনীলস্যরের কথা অবাক হয়ে শুনত বাবাই। স্যরের প্রতিটি কথাই ছিল বেশ ইন্সপায়ারিং। বাবাই যেন ওর হারানো আত্মবিশ্বাস ধীরে ধীরে ফিরে পেতে লাগল। আর হ্যাঁ, সুনীলস্যর প্রতিদিন পড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা বাণী বলতেন, ‘লেখাপড়া করবি যখন মন মাথাতে নিস এঁকে/লিখে সেটা পরখ করিস যায় কি না যায় তা বেঁকে।’ বাণীটা কার, তা জানা নেই, তবে তিনি বলতেন। আসলে সুনীলস্যর খুব সহজেই বাবাইয়ের রোগটা ধরে ফেলেছেন। যা-ই হোক, বাবাই ঠিক করেছে তার এই প্রিয় মানুষটির সব কথাই সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। তাই, বইয়ের কিছুটা অংশ পড়ার পরই বাবাই সেটা না দেখে লিখে ফেলত। বেশ মজা পেত বাবাই। কারণ, ও এখন একবার যেটা পড়ত, সেটা মনে রেখে দিতে পারত সহজেই। শুধু মুখস্থ নয়, সেটাকে লেখার মাধ্যমেই সে তার ভুলগুলো বুঝতে পারত। এবং শুধরে নিত। নিজেই হত নিজের পরীক্ষক।
সে দিন ইস্কুলে আবার সঞ্জীববাবুর ক্লাস। ওকে পড়া ধরতেই সে চটপট ঠিক উত্তর দিল, এমনকী আরও অনেকের উত্তর না দিতে পারা প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিল। স্যর তো অবাক, অবাক কয়েক জন বন্ধুও। আগে প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারার লজ্জায় যে ছেলে মাথা নামিয়ে রাখত, আজ যেন উত্তর দিতে পারার আনন্দে তার মাথাটা আপনা হতেই নেমে গেল। চোখ বুজে সে তার প্রিয় সুনীলস্যরের মুখটা মনে করল, আর সেই কথাটা। আনন্দে তার ঠোঁট দুটো প্রসারিত হল। মনে মনে সুনীলস্যরের উদ্দেশে বলল, ‘ইয়েস, স্যর আমি পেরেছি।’
বিকেলে বাড়ি ফিরে বাবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোলাগাছটায় জল দিচ্ছে আর তার কানে ভেসে আসছে মায়ের সদ্য শেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে...’। মা প্রথম লাইনটা গেয়েই চলেছে।
ও কিন্তু এক বারও সে জন্য বিরক্তিতে ভ্রু তোলেনি। বরং বোঝার চেষ্টা করতে লাগল, মা কেন রেওয়াজ করে।
সুনীলস্যরের প্রতি ভালবাসাই বাবাইয়ের জীবনে নতুন পর্বের সূচনা করেছে। ও বুঝেছে, পড়াশোনা আর পড়ালেখার মধ্যে পার্থক্যটা। ওর স্বপ্নগুলোও তাই বদলেছে। বাবাই আর যুদ্ধের স্বপ্ন দেখে না, দেখে বড় হওয়ার। |