প্রবন্ধ...
হেলমেটহীন
মরা যারা মধ্য-তিরিশ পুরুষ, তাদের অনেকেরই ছোটবেলায় একটা খাতা ছিল। ছবি চেটানোর খাতা। ক্রিকেটার বা ফুটবলারদের বিশেষ মুহূর্তের ছবি আমরা চিটিয়ে রাখতাম। আশির দশকে কপিলদেবের এক দিনের বিশ্বকাপ জেতার পর আমাদের বাবা-কাকারাও টেস্ট থেকে ধীরে ধীরে ওয়ান-ডে’র দিকে ঝুঁকছিলেন। দূরদর্শনে ক্রিকেট সম্প্রচারের সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। তবে সব খেলা দূরদর্শন দেখাত না, দেখানোর প্রযুক্তি ছিল না, স্যাটেলাইট লিঙ্ক ফেলিওর হত। সরি ফর দ্য ইন্টারাপশন লেখা ঝুলিয়ে দিত। তখন এ দিক-ও দিক ঘুরিয়ে ঘড়ঘড়ে ট্রানজিস্টারে কান পাততে হত ফের। যে খেলা জীবন্ত দেখা যেত না, তা নিয়ে নানা স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়ে থাকতাম আর পরদিনের খবরের কাগজ সাদা-কালো যে খেলার ছবি ছাপাত, তা কেটে খাতায় লাগাতাম। রঙিন ছবি দৈবাৎ পাওয়া যেত।
এই আশির দশকেই রবিবার দূরদর্শনে সুনীল গাওস্কর একটি স্লট নিয়েছিলেন— সুনীল গাওস্কর প্রেজেন্টস নামের রবিবারের সেই টিভি-শো শুরু হয়েছিল ১৯৮৭-তে। আমরা মুখিয়ে থাকতাম। আর বাবা-কাকা-জেঠুরা শোনাতেন খেলার পুরনো গল্প। বাংলা মিডিয়ামের কানে গাওস্করের ইংরেজি অনেক সময় পিছলে যেত, গুরুজনদের বলা গপ্পো সেই ফাঁক ভরাট করত। এই আশির দশকেই আনন্দমেলার পাতায় আমরা মন দিয়ে পড়তাম পি কে-র উইং থেকে গোল, পঙ্কজ রায়ের ব্যাটে বলে।
গোগ্রাসে গিলতাম রোভার্সের রয়। ছিয়াশি সালের গরমের ছুটিতে দূরদর্শনে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখার আগেই কমিক্স রোভার্সের রয়-ই ছিল আমাদের দেখা সেরা ফুটবল। বিশ্বায়নের জমানা শুরু হওয়ার আগে যখন চোখে দেখার উপায় আশেপাশে এমন ছড়িয়ে থাকত না, তখন পঙ্কজ রায়কে নিয়ে আমরা প্রায় রূপকথা বুনেছিলাম। বাঙালির প্রতি, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা আর বিমাতৃসুলভ আচরণের কথা এক দিকে শুনতাম, আর বাঙালি ক্রিকেটার ভদ্রলোক পঙ্কজ রায়ও এমন বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন মাঠে-ময়দানে, জেনে চোখ ছলছল করত।
পঙ্কজ রায়ের সেই স্মৃতি চাপা পড়ে গিয়েছিল। কারণ সৌরভ। না-পাওয়ার যে চাপ আমাদের শৈশবে ছিল, সৌরভ তা অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছিলেন। সৌরভও বঞ্চনার শিকার, এমন স্লোগান যে মাঠে ওঠেনি তা নয়। কিন্তু লর্ডসের অভিজাত মাঠে খালি গায়ে জার্সি ঘোরানো সৌরভ বাঙালি ক্রিকেটারের দাপটের ছবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তবু, এই সৌরভ-পরবর্তী সময়ে যখন ভারতীয় ক্রিকেটের ময়দান-ই-জঙ্গ’এর মূলকেন্দ্রে বাঙালি বেশ কিছু দিন অনুপস্থিত, তখন ফের পুরনো রূপকথায় মন রাখতে ইচ্ছে করে। সৌরভের খেলা আর ছবি তো চাইলেই ইউ-টিউবে পাওয়া যায়, স্মৃতিও টাটকা, রঙিন। কিন্তু পুরনো পঙ্কজ? তিনি তো সত্যি রূপকথা— মিষ্টি, এখনও সাদাকালো। লোডশেডিংওয়ালা, ড্যাম্পমাখা দেওয়াল ঘেরা, মারফি রেডিয়ো-বাজা মধ্যবিত্ত বাঙালি গেরস্থালির স্বপ্নের বঞ্চিত, লড়াকু নায়ক। ‘পথের পাঁচালী’-র অপু যেমন তলোয়ারের মতো লাঠি ঘুরিয়ে কর্ণের কথা ভাবত, তেমনই তখনও আমাদের সৌরভ ছিল না বলে ব্যাট-হাতে আমরা পঙ্কজের কথা ভাবতাম।
ষাট বছর আগে। পোর্ট অব স্পেন-এ ভারতীয় ইনিংস ওপেন
করতে যাচ্ছেন মধু আপ্টে, পঙ্কজ রায় (ডান দিকে), ১৯৫৩।
ক্রীড়া সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্যের পঙ্কজ/রায়বাড়ি অনুমোদিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী (দীপ প্রকাশন) পড়তে পড়তে সেই রূপকথায় আবার ঘাই মারা গেল। পঙ্কজ হেলমেটপূর্ব সময়ের প্লেয়ার। কাটা গ্লাভস আর পাতলা প্যাডে সামলাতেন ফাস্ট বোলারদের। ওভার পিছু বাউন্সার বিমার দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা তখন ছিল না। খেলা হত আনকভারড উইকেটে। এত ভাল ব্যাট পাওয়া যেত না। কন্ট্যাক্ট লেন্স তখন ভারতে কোথায়— চশমা পরে, হেলমেটহীন মাথায় খেলতেন পঙ্কজ। দেশ সাতচল্লিশে স্বাধীন হল। সেই ভাঙা-দেশে হাজারও সমস্যা। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তখন দাগ কাটার মতো বাঙালি নেতৃত্ব নেই। বাংলা ভাষার গান জাতীয় সংগীত হতে পারে, কিন্তু হিন্দি কাজ-কামের ভাষা। এই সময় গত শতকের পাঁচ দশকে টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচটা সেঞ্চুরি করেছিলেন বাঙালি পঙ্কজ। তার মধ্যে একটা আবার জামাইকার স্যাবাইনা পার্কে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। মোহনবাগানের খালি পায়ে গোরাদের হারানো নিয়ে বাঙালি যদি পরাধীন ভারতে উত্তাল হতে পারে, তা হলে ভগ্নস্বপ্ন স্বাধীন ভারতে ১৯৫২-৫৩ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিদেশের মাঠে পঙ্কজের করা ১৫০ নিয়ে বাঙালি বুঁদ হবে না কেন! ছবি দেখা যেত না, খবর ঠিক মতো সময় আসত না— তবু শিরশিরে আনন্দের অনুভূতি ছড়িয়ে যেত। গল্প মুখে মুখে বইত। আশির দশকে আমরা শুনতাম, ‘ব্যাটে বলে’-তে পড়তাম।
পঙ্কজের রূপকথায় আরও দুটো উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ ছিল। পঙ্কজ আর ভিনু মাঁকড় ওপেনিং জুটিতে ৪১৩ রান করেছিলেন। তাঁদের সেই রেকর্ড ৫২ বছর অক্ষত ছিল। রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ক্রিকেট ইতিহাস সচেতনের মন্তব্য— ‘কী অসম্ভব ফিটনেসের দরকার হয়! অথচ ওঁদের না ছিল ফিজিয়ো, না কোনও ট্রেনার...’ অন্য স্তম্ভটায় নাটকীয়তার কারুকার্য আরও বেশি। ১৯৬৩। হায়দরাবাদের সঙ্গে বাংলার রঞ্জি ম্যাচ। ‘তা-ও ফাইনাল নয়, নিছক শেষ আটের লড়াই।’ হায়দরাবাদের হয়ে খেলছিলেন গিলক্রিস্ট। উইকেট নয়, তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্যাটসম্যানের শরীর। ১৯৮৪-তে ভারতীয় দূরদর্শন ন্যাশনাল স্লটে বডিলাইন সিরিজের ওপর ধার করে একটা বিলিতি টেলিভিশন ড্রামা দেখাত। ১৯৩২-৩৩’এর ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার লড়াই দূরদর্শনের পরদায় দেখা যেত। শরীর লক্ষ্য করে বল করা কী হতে পারে, টের পাওয়া গিয়েছিল। ৬৩-র রঞ্জি ম্যাচে গিলক্রিস্ট বাংলা বধের জন্য তা-ই করেছিলেন। সঙ্গে যোগ হয়েছিল অভব্য আগ্রাসী বডি ল্যাংগোয়েজ। সেই খুনোখুনি ম্যাচে অকুতোভয় পঙ্কজ। মাথা উঁচু করে দু-ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেছিলেন। গৌতম তাঁর বইতে জানিয়েছেন, পঙ্কজের সঙ্গে হালকা রেষারেষি ছিল নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের। নির্মল ছিলেন পঙ্কজের বিপরীত ঘরানার ব্যাটসম্যান, তাঁকে বলা হত বাংলার মুস্তাক। সেই নির্মলও সে দিন পঙ্কজের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘আমি বেস্ট-ফর্মের মার্চেন্ট-হাজারে দেখেছি। কিন্তু তোমার চেয়ে পেস বোলিং ওরাও ভাল খেলতে পারত না।’
সময় বদলাচ্ছে। ছবি ধরে রাখার হাজারও সরঞ্জাম, হাতে হাতে ঘুরছে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন ছড়িয়ে পড়া ছবি। এরই মধ্যে ছোটবেলার সেই হারিয়ে যাওয়া খাতার জন্য মন কেমন করে। কত নিঝুম দুপুর তার সাক্ষী। সেই জগতের শোনা-কথার পড়া-কথার নায়ক পঙ্কজ। চশমা-পরা বাঙালি ভদ্রলোক। এই গ্রন্থের সুবাদে সেই সব হারানো দিনের গন্ধে, সুখে শরীর ডোবানো গেল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.