ডেট্রয়েট শহরের বুকে এখন ঘুরিতেছে পঞ্চাশ হাজার বেওয়ারিশ কুকুর। এক সময় গাড়ি উৎপাদনে সমগ্র বিশ্বে অগ্রগণ্য এই শহর ছিল অতীব সচ্ছল, অর্থনৈতিক মন্দা আসিয়া সেই সমৃদ্ধি কাড়িয়া লইয়াছে, আঠারো লক্ষ জনসংখ্যা নামিয়াছে সাত লক্ষে। দলে দলে মানুষ শহর ছাড়িয়া অন্যত্র গিয়াছেন, কিন্তু পোষ্যকে সঙ্গে লইয়া যান নাই। সেই কুকুরগুলি এখন ঘুরিতেছে, কামড়াইতেছে, চেঁচাইতেছে, নূতন বেওয়ারিশ কুকুরের জন্মও দিতেছে। আমাদের নিকট এই চিত্র অতীব পরিচিত, কাহারও অতিশয় প্রিয়ও। এই বঙ্গের কোন চিত্র নেড়ি কুকুর ব্যতীত সম্পূর্ণ? কোন পাষণ্ড গৃহস্থ তাঁহার মধ্যাহ্নভোজের উচ্ছিষ্ট ‘আ তু তু ’ ডাকিয়া একাধিক নেড়িকে ভাগ করিয়া দেন না? কিন্তু মার্কিন দেশে ভিন্ন দস্তুর। সেখানে কুকুরমাত্রেই হইতে হইবে ব্যক্তিমালিকানাধীন, কুকুরের সকল দায় লইতে হইবে তাহার পালককে, প্রভাতে বা বৈকালে সারমেয়-সফরকালে কুকুর-ত্যক্ত পুরীষও প্রভুকেই কুড়াইয়া বর্জ্য-পাত্রে ফেলিতে হইবে। মালিকবিহীন কুকুরকে কিছু দিন বন্দি অবস্থায় রাখিয়া তাহার পর মারিয়া ফেলাই নিয়ম। ডেট্রয়েটে এই মুহূর্তে বেওয়ারিশ কুকুর ধরিবার দফতরের কর্মিসংখ্যাও এমনই কমিয়া গিয়াছে, নিয়ম লাগু করিবার সামর্থ্যও নাই। ফলে বহু কুকুর তাহাদের দেশের প্রেক্ষিতে আশাতীত সৌভাগ্য ভোগ করিতেছে। তাহারা যদি জানিতে পারিত পশ্চিমবঙ্গে তাহাদের বেওয়ারিশ জাতভাইদের কী রূপ সমাদর, দলে দলে পাসপোর্ট করিতে লাইন দিত, সন্দেহ নাই। |
যদিও সামগ্রিক ভাবে জীবনের মূল্য প্রদানের অভ্যাস প্রাচ্য অপেক্ষা পাশ্চাত্যে অধিক, কিন্তু নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তুঙ্গে লইয়া যাইবার প্রতিজ্ঞা উহাদের বহু প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর করিয়া তুলিয়াছে। তাহার তুলনায় আমাদের স্বভাবশিথিল সমাজ পশুদের প্রতি নির্বিচার নৃশংসতাও চালাইতেছে, আবার কোনও সময় পশুপ্রেমের পরাকাষ্ঠাও প্রদর্শন করিতেছে। কোনও অমানুষ আসিয়া নেড়ি কুকুরকে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিলেও প্রতিবাদ জানাইবার লোক নাই, আবার কেহ বাড়ির বারান্দায় পঞ্চাশটি নেড়িকে আশ্রয় দিয়া সামনের পথে ডেসিবেল-বিভীষিকা সৃষ্টি করিলেও সরকারে নালিশ জানাইবার উদ্যম কাহারও মধ্যে দেখা যাইবে না। এই উদাসীন সমাজে সকলই চলে, তাই প্রেমও কেমন করিয়া তাহার পথ খুঁজিয়া লয়। পুরসভা হইতে কুকুর ধরিবার অভিযান চালাইলে, বহু বস্তিবাসী তড়িঘড়ি নেড়িদের লইয়া নিজ গৃহে লুকাইয়া রাখেন। প্রায়ই দেখা যায়, পথকুকুরকে শীতকালে একটি জামা পরাইয়া রাখা হইয়াছে, হয়তো কৌতুক-নিমিত্তও, কিন্তু কেহ যত্ন করিয়া সেই জামাটি তৈয়ারি করিয়াছে, ছোট ছোট চারটি হাতাও রহিয়াছে! খাইবার জন্য অধিকাংশ নেড়িরই বাঁধা বাড়ি আছে, ঠিক সময়ে খাদ্য না পাইলে তাহারা সশব্দ অনুযোগ করিয়া থাকে, ত্রৈলোক্যনাথ হইলে বলিতেন: কুকুরগুলিই ওই মানুষদের পুষিয়াছে। আর পথবাসী গরিব মানুষের সহিত নেড়ি কুকুরদের তো আশ্চর্য সখ্য। তাঁহারা নেড়িদের সহিত নিত্য খেলা করিয়া, খাদ্য ভাগ করিয়া, রোগে সেবা করিয়া, বর্ষায় রাস্তায় জল জমিয়া গেলে নিজ শয্যায় স্থান দিয়া, শাসনে-সোহাগে নিজেদের জীবনে অবিচ্ছেদ্য আসনে অভিষিক্ত করিয়াছেন। আমাদের দেশে প্রাণের মর্যাদা নাই, কিন্তু প্রশ্রয় আছে। এখানে দলে দলে কুকুর ঘুরিলে সরকার হইতে তাহাদের সংস্থানের ব্যবস্থা হয় না, আবার তাহাদের হত্যা করিয়া নগরজীবন বিপন্মুক্ত রাখিবার ধারণাও কাহারও মাথায় চট করিয়া আসে না। চালচিত্রটি তাহাতে তকতকে হইল না ঠিকই, কিন্তু বৈচিত্রে ও জীবনস্রোতে ঝলমল করিল! |