নবাব হতে চেয়েছিলেন কেবল মির জাফরই |
‘ডাকঘর’ বিভাগে ১০ অগস্ট এস এম রেজা আলি খানের এবং ২৭ জুলাই সৈয়দা হুসনা জা-র পত্রে মির জাফর ও ‘নেমকহারাম দেউড়ি’ প্রসঙ্গে ইতিহাসের নামে কিছু ভুল ও বিকৃত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহাসিক সুশীল রায় চৌধুরীর ‘নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ’, ‘পলাশির অজানা কাহিনি’, রামপ্রসাদ পালের ‘পলাশির ডায়েরি’, রাধারমণ রায়ের ‘কলকাতা বিচিত্রা’ ও অনিরুদ্ধ রায়ের ‘মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস’ থেকে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা হল।
রানি ভবানী, জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদের সঙ্গে লর্ড ক্লাইভের কোনও চুক্তি হয়নি। কিন্তু ১৭৫৭ সালের ৫ জুন কাশিমাবাজার ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস বোরখা পরে গোপনে জাফরাগঞ্জ প্রাসাদে মির জাফরের কাছে আসেন কলকাতার সিলেক্ট কমিটির প্রস্তাবিত চুক্তি স্বাক্ষরিত করতে। চুক্তিপত্র ছিল দু’টি— সাদা রঙের চুক্তিপত্রটি আসল ও লালটি নকল। উমি চাঁদের পাঁচ শতাংশ কমিশন পাওয়ার কথা ছিল নকল চুক্তিপত্রে। মির জাফর সিলমোহর দিয়ে দু’টি চুক্তিপত্রে সই করলেও, কলকাতায় ১১ জুন অ্যাডমিরল ওয়াটসন নকল চুক্তিপত্রে সই করতে রাজি হননি। তখন লসিংটন নামে এক ইংরেজ ওয়াটসনের সই নকল করেন। এ সবই হয়েছে লর্ড ক্লাইভের নির্দেশে। প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচারকে ক্লাইভ প্রথম থেকেই হাতিয়ার করেছিলেন। এ সব সমর্থন করে গিয়েছেন মির জাফর। চুক্তিপত্রেও নবাব পদ প্রার্থী ছিলেন একমাত্র মির জাফর। রানি ভবানী, রায় দুর্লভ, জগৎ শেঠ, উমি চাঁদরা কিন্তু নন। তাহলে মির জাফর কি করে ‘সেই চুক্তির শেষ নাটকীয় চরিত্র’ হন?
|
হাজারদুয়ারীর ভিতরের চিত্র। রবার্ট ক্লাইভকে কুর্নিশ করছেন মির জাফর। ছবি: পত্রলেখক। |
হুসনা জা-র চিঠি পড়ে মনে হল, সিরাজের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে মুর্শিদাবাদবাসীর একমাত্র উদ্ধারকর্তা ক্লাইভ। অথচ ক্লাইভই সিরাজের ধনাগার লুণ্ঠনের পর নৌকাভর্তি ধনসম্পত্তি সৈন্য পাহারায় কলকাতায় নিয়ে যান।
মির জাফর প্রথম দিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রিয়পাত্র ছিলেন। কলকাতা আক্রমণের পর তিনি নবাবের সুনজরে পড়েন ও বক্সিপদ লাভ করেন। আবার ইংরেজরা চন্দননগর দখল করে নিলে মির জাফর সর্ম্পকে সিরাজ সন্দিহান হন এবং বক্সিপদ থেকে তাঁকে অপসারিত করেন। কিছুদিন পর ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালোনোর কথা ভেবে পুনরায় তাঁকে বক্সিপদে ফিরিয়ে আনেন। সিরাজের এই সিদ্ধান্তে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন মোহনলাল, মির মদন, আব্দুল হাদি খানেরা। সিরাজ সেদিন কারও কথাই শোনেননি। এটা সিরাজের এক বিরাট ভুল। কিছু দিন পর পুর্ণিয়ার নবাব অর্থাৎ সিরাজের ভাই শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মদত দেন মির জাফর। মির জাফর চিঠি লিখে শওকত জঙ্গকে জানান, কয়েকজন সেনাপতি ও মুর্শিদাবাদ দরবারের কয়েকজন অমাত্যকে নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। শওকত জঙ্গের অবহেলা ও নেতৃত্ব দেওয়ার দুর্বলতার জন্য মির জাফরের পরিকিল্পনা ব্যর্থ হয়।
কোরান ছুঁয়ে সিরাজকে সব রকম সহায়তার কথা বললেও পলাশির যুদ্ধে অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে মির জাফর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। নবাব তাঁকে তাঁর দিকে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও মির জাফর কিন্তু তাঁর জায়গা থেকে একচুলও নড়লেন না। পলাশির যুদ্ধে মির মদনের মৃত্যুর পর সিরাজ নিজের রাজমুকুট খুলে মির জাফরের পায়ের নিচে রেখে নিজের প্রাণ ও বাংলার সম্মান ভিক্ষা চাইলেন। মির জাফর সেদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ রেখে পরের দিন যুদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন। ক্লাইভকেও সেই সংবাদ পাঠিয়ে দিলেন। সিরাজ-অনুগত সেনাপতিরা যুদ্ধ বন্ধ রাখার বিরোধিতা করেন। সিরাজের অনুরোধ তাঁরা উপেক্ষা করতে পারেননি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বিকাল সাড়ে চারটেয় সিরাজ পলাশি থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। নবাব বাহিনী পিছন ফিরতেই ইংরেজ বাহিনী তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় নবাব বাহিনী। যুদ্ধ শেষ হতেই সন্ধ্যা ৬টায় মির জাফর ক্লাইভকে বার্তা পাঠায়, “Congrulate you on executing your design.” শান্তনু বিশ্বাস, মুশির্দাবাদ (লালবাগ) |