কোনও দিন বিলিয়ার্ডস খেলেননি?’ প্রশ্ন কৌশিক সেনের। ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব। ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে এগারোটা ছাড়িয়েছে। গাড়ি থেকে একটু আগেই নেমেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নেভি ব্লু হাফ শার্ট, বেইজ রঙের ট্রাউজারে মোড়া ছিপছিপে শরীর জুড়ে আভিজাত্যের কিরণ সকালের সূর্যের টাটকা আলোকেও লজ্জা দিচ্ছে। ক্লাবের বিলিয়ার্ডস রুমে তাঁর সঙ্গী কৌশিক।
‘ওই এক আধ বার খেলেছি হয়তো,’ বলেই ফোটোগ্রাফারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছবি তোলা হল?’
কাট।
পরের দৃশ্য অন্য একটি ঘরে। এসি একটু কম করে দিতে বলে এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলেন।
‘চা?’
‘চিনি কম।’
একটু বাদেই জমে উঠল আড্ডা। আবার তো তিনি নায়ক। শহরের দেওয়ালে তাঁর নতুন ছবির পোস্টার তো তাই বলছে। কিন্তু সে কথায় যাবার আগেই উঠে এল অন্য এক প্রসঙ্গ। মহানায়ককে নিয়ে। শোনা গিয়েছিল প্রযোজক রাজি না হওয়ার কারণেই নাকি তিনি উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবি পরিচালনা করতে পারেননি...
সৌমিত্র: হ্যাঁ, তবে এর পিছনে একটা গল্প আছে। ‘স্লুথ’ বলে একটা বিদেশি ছবি আমার দারুণ লেগেছিল। মাইকেল কেইন আর লরেন্স অলিভার। একদিন উৎপলদা (উৎপল দত্ত) বললেন ‘স্লুথ’-কে অ্যাডাপ্ট করতে। উনি পরিচালনা করবেন। আমরা দু’জনে অভিনয় করব। আমি লিখলাম। ওঁর ভালও লেগেছিল। কিন্তু ওঁর দল করতে দিল না।
পত্রিকা: তার পর?
সৌমিত্র: ওই ‘স্লুথ’-য়ের স্ক্রিপ্ট নিয়েই উত্তমদার সঙ্গে কাজ করার কথা ছিল। ওকে বলেছিলাম, নাটক করবে? উত্তরে ও বলল, না শক্ত সিন করতে গেলে সরবিট্রেট খেতে হয়। ডাক্তার নাটক করার পারমিশন দেবেন না। ও বলল, তুই সিনেমা পরিচালনা কর। আমি অভিনয় করব। আমাকে টাকাও দিতে হবে না। বক্স অফিসে রোজগার হলে আমি সেখান থেকে পয়সা নেব। শুধুমাত্র একজন প্রযোজক জোগাড় করতে হবে। তখন আমরা যে ব্যানারে কাজ করছি, সেখানে উত্তমদার অন্তত পঁচিশটা সুপারহিট ফিল্ম। আমার কম করে দশটা সুপারহিট। আমি ওদের ছবিটা প্রযোজনার জন্য বললাম। প্রযোজক শুনলেন। তার পর কোনও উত্তর নেই। উত্তমদা নিজে থেকে ফোন করে প্রযোজককে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়নি। আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করত, উত্তর এল কি না। একদিন প্রযোজক বললেন, ‘ছবিতে হিরোইন নেই। মফস্সলে চলবে কি?’ সে রাতে উত্তমদার আবার ফোন। ‘কিছু জানালো?’ বললাম। শুনে বলল, ‘শালা, এখানে কিছু হবে না।’
কৌশিক: মঞ্চেই তো আমরা ‘টিকটিকি’ করে দেখিয়ে দিলাম যে ওটা হাউসফুল হতে পারে। আবার আমরা একসঙ্গে অতনু ঘোষের ‘রূপকথা নয়’-য়ে। তপন সিন্হার ‘হুইল চেয়ার’ করেছিলাম। তার পর ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’। সুমন ঘোষের ‘দ্বন্দ্ব’ করেছিলাম। কিন্তু একসঙ্গে কোনও দৃশ্য ছিল না।
|
পত্রিকা: কৌশিককের সঙ্গে সিনেমায় কাজ করতে কেমন লাগল?
সৌমিত্র: অতনুর টেলিফিল্ম করেছি আমরা। রানিং-য়ে বলে না, স্পারিং পার্টনার কে, তার ওপর দৌড়ের গতিটা নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে বাবান (কৌশিক) থাকলে তো আমার ভাল লাগে। বাবান বুদ্ধি দিয়ে অভিনয় করে। এবং একটা এক্সপোজার আছে। শিল্পগত মূল্যবোধ আছে। এগুলো সহ-অভিনেতার মধ্যে থাকলে ভাল লাগে। বুদ্ধি এবং নিজের আবেগকে বাইরে আনার যে একটা তাগিদ থাকে, এই দুটোকে এক জায়গায় মেলাতে পারলে অভিনয়ে অনেক দূর এগোনো যায়। সেই সঙ্গে সঙ্গে একটা বয়েসে আসার পর অভিনয় শুধুমাত্র আত্মপ্রকাশের তাগিদ বলে তো আর কিছু থাকে না। তার থেকে বেশি থাকে আমার অভিজ্ঞতাকে কতটা প্রয়োগ করতে পারছি। আমি যত মানুষ দেখেছি, যত জীবনের বৈচিত্র দেখেছি সেগুলো তো আনার একটা চেষ্টা থাকে। ‘রূপকথা নয়’-য়ের মধ্যে সেই চেষ্টাটা রয়েছে।
পত্রিকা: এই ছবিতে আপনার চরিত্রে অদ্ভুত একটা বৈপরীত্য রয়েছে। ভদ্রলোকের পরিবার বেশ গোলমেলে। তাঁর স্ত্রী একটা সীতাহারের জন্য আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু এ সবের মধ্যেও তিনি রোজ পার্কের বেঞ্চে বসে বাইরের জগতের লোকের জীবনটা একটু মসৃণ করার চেষ্টা করেন...
সৌমিত্র: এটা আমার নিজের জীবনদর্শনের সঙ্গে মেলে।
কৌশিক: ছবিতে কাকুর চরিত্রের এই এই বৈপরীত্য আমার চরিত্রকেও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সিনেমায় আমি অঙ্কের শিক্ষক। কিন্তু কাজে মরচে পড়েছে। জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা তৈরি হচ্ছে। তখন কাকুর চরিত্রটা আমায় ইন্সপায়ার করে। বাস্তবেও তাই। আমার অভিনয়ের প্রাথমিক শিক্ষাটা আমার বাবা শ্যামল সেনের কাছে। বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন কাকুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আমি সেসময় ‘কালপুরুষ’ করছি। কাকু বাবাকে চিঠি লিখে বলেন, ‘আমার নতুন নাটকের জন্য বাবানকে দরকার’।
পত্রিকা: কেন হঠাৎ কৌশিক?
সৌমিত্র: যাদের আমি ডিরেক্ট করেছি, তাদের মধ্যে বহু এক্সট্রাঅর্ডিনারিলি ব্রিলিয়ান্ট অভিনেতা ছিলেন। যেমন রবি ঘোষ। কিন্তু নতুন বা অল্প দিন এসেছে, এমন যাদের ডিরেক্ট করেছি, তাদের মধ্যে দুজনকে দেখেছি যারা ‘অলরেডি দেয়ার’। একজন বাবান, আর একজন আমার মেয়ে পৌলমী।
কৌশিক: কাকুর সঙ্গে আলাপের পর থেকে আমার অভিনয়ের ট্রেনিংটা কনটিনিউ করছে। তবে এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলব। আমাদের থিয়েটারে এখন একটা ট্রেন্ড এসেছে। নিজেকে দেখানোর অভিনয়। এইটা আমি কাকুর মধ্যে দেখিনি। তা সে ‘রাজা লিয়ার’, ‘প্রাণতপস্যা’, ‘হোমাপাখি’ বা ‘আত্মকথা’ যাই-ই হোক। যখন চরিত্রর প্রয়োজন তখন নিজেকে প্রজেক্ট করেছেন। আবার প্রয়োজন মতো গুটিয়ে নিয়ে মঞ্চে থাকা সত্ত্বেও প্রায় ইনসিগনিফিকেন্ট করে ফেলেছেন নিজেকে। ওঁর থেকেই শিখেছি, কতটা নিজেকে কমের মধ্যে প্রকাশ করা যায়।
সৌমিত্র: এই নিজেকে দেখানোর ইচ্ছেটা অন্তত প্রাথমিক স্তরের অভিনেতাদের মধ্যে থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে একটুখানি এগোয়, সে বোঝে আত্মপ্রদর্শন নয়, সত্যপ্রদর্শন করতে হবে। সেটাই তার যাত্রাপথ।
কৌশিক: মনোজ মিত্র একবার আনন্দবাজার পত্রিকা-তে সৌমিত্রকাকুর অভিনয় শৈলী নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন। সেখানে তিনি কাকুর অভিনয়কে এরোপ্লেন আর পাখির উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। এরোপ্লেনের ওড়ার মধ্যে দাপট রয়েছে। পাখির ওড়াটা মসৃণ। নির্ভার। মনোজকাকু বলেছিলেন, সৌমিত্রকাকুর অভিনয়টা পাখির উড়ে যাওয়ার মতো। মনে আছে ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকে যখন মাতাল হতেন। একজন মানুষ ড্রিংক করতে করতে বেসামাল হয়ে গিয়ে কী ভয়ঙ্কর সত্যি কথা বলে ফেলেন! প্রথমবার বিশ্বরূপা-র মতো হলে দেখেছিলাম। পেশাদার থিয়েটারের যাবতীয় গণ্ডগোলগুলি সমস্ত হলে বিদ্যমান। হকার চলাফেরা করছে, বেড়াল ঘুরছে। তার মধ্যে সেই ম্যাজিক!
পত্রিকা: এত বাধাবিপত্তির মধ্যে অভিনয় করতেন কী করে?
সৌমিত্র: দিন গেলে নিজের অভ্যেসের থেকে জিনিসগুলো তৈরি হয়। আমি যখন অভিনয় শুরু করেছিলাম, তখন একটা বেড়াল চলে গেলে মনে হত, এদিন আর বোধহয় অভিনয়টা ঠিকঠাক হবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে মানতে শুরু করি যে আমার মনোসংযোগের চাবিটা আমার কাছেই থাকবে। বেড়াল যদি আমায় ডিসট্র্যাক্ট করে, আমি আবার চাবিটা ঘুরিয়ে মনোসংযোগটা ফিরিয়ে আনব। ‘নীলকণ্ঠ’য় একটা প্রচণ্ড ট্র্যাজিক মোমেন্টে হঠাৎ লোকে হেসে উঠল। আমি তো বুঝতে পারছি না কেন। আমার কোনও জামাকাপড় খুলে গেল নাকি? তারপর দেখি একটা বেড়াল রাজকীয় ভঙ্গিতে স্টেজটা ক্রস করল। আমি যদি দর্শককে বলি, ‘দেখছেন তো কী অবস্থা?’ তাতে তো আমার মনোসংযোগ আরও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি চুপ করে বেড়ালটাকে দেখলাম। তার পর আবার শুরু করলাম।
কৌশিক: এখন বেড়ালের পরিবর্তে এসেছে মোবাইলের উৎপাত। অভিনয় থামিয়ে দিয়ে বলি, সুইচ অফ করুন। তারপর আবার শুরু করি।
পত্রিকা: একবার কলকাতায় স্টেজে এক শিল্পীর মোবাইল বেজে ওঠে ...
সৌমিত্র: এটা একবার আমারও হয়েছিল। আবৃত্তি করছিলাম। আমাকে সবে একটা মোবাইল দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ সেটা বেজে উঠল। পকেট হাতড়াচ্ছি। কিন্তু ঠিকমতো তো জানি না, কী ভাবে অফ করব। ওটা কিছুক্ষণ বেজে থেমে গেল। তবে এর পর আর অমন হয়নি।
পত্রিকা: আপনাকে কোনও দিন দেখিনি ব্লগ, টুইটার, ফেসবুকে কিছু লিখতে।
সৌমিত্র: আমি কমপিউটার ইল্লিটারেট।
পত্রিকা: অমিতাভ বচ্চন তো ঐশ্বর্যা রাইয়ের প্রেগনেন্সির খবরটা কোনও মিডিয়াকে না বলে টুইটারে প্রথম নিজেই অ্যানাউন্স করেছিলেন...
সৌমিত্র: যাঁরা করেন, তাঁদের দোষ দিচ্ছি না। এটার অনেক অ্যাডভান্টেজ আছে। কিন্তু আমার মনের একটা দিক একটু অন্তঃচারী, নিভৃতচারী। আমি একটু পদ্য-ফদ্য লিখি তো। একটু নিজের মতো থাকতে চাই। ‘আমায় থাকতে দে না আপন মনে’... এটা আমার মনের মধ্যে কাজ করে।
পত্রিকা: বিদেশে সত্তরোর্ধ্ব সব অভিনেতা যেমন মাইকেল কেন, অ্যানথনি হপকিনস, ক্লিন্ট ইস্টউডেরা তো সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন। কখনও কি মনে হয় যদি বিদেশে থাকতেন এখন?
সৌমিত্র: করতে এখনও চাই। কিন্তু শারীরিক সীমাকে মানতে বাধ্য হচ্ছি। মাঝে মাঝে বেশি পরিশ্রম করলে ছেলেমেয়ে একটু রেগে যায়। তবে আমার মনে পড়ে ওয়াসিম আক্রমের বোলিং-য়ের কথা। ডায়াবেটিস ইনজেকশন নিয়েও মাঠে গিয়ে ওই স্পিডে বল করত। আই হ্যাভ নো আদার অপশন, বাট টু ফাইট। লড়াই করা ছাড়া আমার উপায় নেই। এই যেমন কানে ঠিক মতো না শুনতে পাওয়ার ব্যাপারটা। যখনই নিজে এটা বুঝতে পারি, তখন এটা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশাই করি।
পত্রিকা: এই যে ‘আমোর’ ফিল্মটা দুই বয়স্ক অভিনেতাকে নিয়ে হল...
সৌমিত্র: অসাধারণ সিনেমা। দেখে দু’দিন ঘুমোতে পারিনি।
পত্রিকা: বাঙালি পরিচালকেরা আপনার গুণমুগ্ধ। তবু কেন তেমন চরিত্রে আপনাকে দেখা যায় না?
সৌমিত্র: যুগযুগ ধরে অভিনেতাদের নানা রকমের কাজ করতে হয়। কিন্তু অভিনেতাদের যদি প্রাণটা বেঁচে থাকে তা হলে সে সব সময় ভাবে কবে একটা ভাল কাজ করতে পারব। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর সব থেকে যেটা আমাকে বিব্রত করেছিল, তা হল উনি থাকাকালীন দু’-আড়াই বছর পর পর আমার ডাক আসত ছবি করার জন্য। উনি চলে যাওয়ার পর ওই রাস্তাটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি খুব লাকি তার আগে তপনদাদের সঙ্গেও কাজ করেছি। ‘হুইলচেয়ার’ করেছিলাম। বয়সের কারণেই কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো কম হতে থাকল। কিন্তু যে সমস্ত গল্প সাধারণত হয় সেখানে বৃদ্ধকে সেন্ট্রাল ক্যারেকটার দেখা যায় না।
কৌশিক: বলিউডে তো হচ্ছে। অমিতাভ বচ্চন, নাসিরউদ্দিন শাহ, পরেশ রাওয়াল, অনুপম খের তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন....
পত্রিকা: এটা কি মাইন্ডসেটের সমস্যা?
সৌমিত্র: ভারতীয় ছবিতার মধ্যে আবার বাংলা ছবি... এত আনইনভেনটিভ এই সব কাহিনি-টাহিনির ব্যাপারে... অন্য কী করলে বক্স অফিস হবে তা ভেবে দেখে না। ভাবে বুঝি ওটা বক্স অফিস, ওটাই করি। মানিকদাকে ‘পথের পাঁচালী’র রিসেপশন দেওয়া হয়েছিল সেনেট হলে। সবাই সুখ্যাতি করল বক্স অফিসকে অগ্রাহ্য করে এই ছবি তৈরি হয়েছিল বলে। মানিকদা বললেন, বক্স অফিসকে অগ্রাহ্য করা হয়নি। কোনও পরিচালকই চান না যে তাঁর ছবি ফ্লপ করুক। এইটুকু বলতে পারি আমার বক্স অফিস সম্পর্কে ধারণাটা আলাদা ছিল। অন্য অনেক কিছু করেও যে বক্স অফিস হতে পারে সেটা আমি ভেবেছি। সে সব আজকাল কেউ ভাবে না। তার জন্য আমরা অব্যবহৃত, অকৃতার্থ হয়ে পড়ে থাকি।
পত্রিকা: আজকালকার ছবি সম্পর্কে আপনার মত?
সৌমিত্র: একটা সময় সাউথের ছবি দেখে এখানে কাজ হত। সেটা এখন থেমেছে। তবে ‘আমোর’-য়ের মতো জীবনের তুলি দিয়ে আঁকা ছবি কোথায়? শুধুমাত্র সেলসম্যানের গ্রিপ থাকলে চলে না। চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ মনে আছে? যিনি প্রযোজক ছিলেন গল্পটাও তাঁরই লেখা ছিল। কিছু ওভারড্রামাটিক সিকোয়েন্স থাকলেও সিনেম্যাটিক দিক থেকে কত উন্নত ছিল। |
পত্রিকা: ‘শিপ অব থিসিয়াস’-য়ের প্রযোজক ছবিতে অভিনয় করেছেন।
সৌমিত্র: আমি দেখিনি। তুই দেখেছিস?
কৌশিক: হ্যাঁ। কী অসাধারণ সিনেমা। তবে এটা বলব যে এখানেও কিছু ভাল কাজ হচ্ছে। বালিগঞ্জ আর সাউথ সিটির গল্প থেকে বেরিয়ে এসে চেতলার ছায়ামানুষের গল্প দেখছি আমরা বাংলা সিনেমাতে। যেমন আমাদের ছবিটা। একজন বয়স্ক চরিত্র একটা গোটা ফিল্মের কেন্দ্রে। আশা করব এই রকম একটা ছবি করে অতনু এবং এই ছবির প্রযোজক ‘ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন’ বাংলা ছবিতে একটা নতুন রাস্তা দেখাবে।
পত্রিকা: রাজ কপূর নাকি আপনাকে ‘সঙ্গম’-য়ে নিতে চেয়েছিলেন?
সৌমিত্র: হ্যাঁ। দিলীপকুমার আমাকে ‘আদমি’ ছবির জন্য অফার দিয়েছিলেন। তার পর সেই অফারটা মনোজকুমারের কাছে যায়। মুম্বই না যাওয়ার কারণটা ভাষাভিত্তিক নয়। আমি ওই শহরটায় দু’চারবার গিয়ে দেখেছি যে ওখানে গিয়ে থাকতে-টাকতে পারব না। সিনেমা ছাড়াও যে আমার আরও কিছু জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ছিল সেটা ওখানে গেলে মরে যেত। ভাষাটা শিখে ফেলতাম। যদিও আমি মনে করি যে সব থেকে ভাল অভিনয় মাতৃভাষাতেই সম্ভব। আর বাংলা ভাষাটা বলে আমি তৃপ্তি পাই।
পত্রিকা: বাঙালি পরিচালকেরা বলিউডেও নানা ধরনের কাজ করছেন। ইচ্ছে করে না যদি একটা চ্যালেঞ্জিং রোল কেউ দেয়?
সৌমিত্র: ইট ইজ এ লিটল টু লেট ইন দ্য ডে। সুজয় ঘোষ বাড়িতে এসে আমাকে ‘কহানি’র ডিভিডি দেখিয়েছে। দারুণ লেগেছিল। ও বলেছিল, ওর ছবিতে বললে আমাকে করতেই হবে।
কৌশিক: কাকু আজও চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করতে চান।
সৌমিত্র: এই প্রসঙ্গে দিলীপকুমারের আরেকটা কথা মনে পড়ল। একটা ছবি ওঁকে অফার করা হয়েছিল কিন্তু উনি করেননি। আমাকে বলেছিলেন যে চরিত্রের ভার ছিল না। উনি বেশি ওজনদার চরিত্র করতে চেয়েছিলেন।
পত্রিকা: ‘রূপকথা নয়’-য়ের পোস্টারে লেখা ‘আবার আমি নায়ক’। আগে, ‘অলীক সুখ’-য়ে আপনার একটা দৃশ্যে অভিনয় দেখে অনেকে বলেছেন, ওটা ফিল্মের ‘আইটেম সিন’!
সৌমিত্র: বাবান যে বলল ওই অল্পতে বেশি দেখানো যায়। ওটাও আমার পার্সোনাল অ্যাসথেটিক্সের মধ্যেই পড়ে। আমি যখন কলেজে তখন ‘চাইনিজ আই’ বলে চিনা পেন্টিংয়ের ওপর বই পড়েছিলাম। সেই পেন্টিং-য়ে আদর্শ হল, মিনিমাম স্ট্রোকে ম্যাক্সিমাম এফেক্ট। আমি দেখলাম এটা আমাদের কাজেও তো লাগানো যায়। সিনেমার শিক্ষাতেও এরকম কথা আমি পেয়েছি মানিকদার থেকে। আমি তখন বছর ছয়েক হল সিনেমা করছি। তখন মনে হল কোনও সময় যেন আমার স্ক্রিন প্রেজেন্সটা ‘ডেড’ না হয়ে যায়। তখন যে সব ছবিতে অভিনয় করতাম সেটা করার চেষ্টা করতাম। সেই রকম একটা ছবি মানিকদা দেখেছিলেন। বলেছিলেন ‘তুমি ওই সিনটায় চোখের ব্যবহার করেছ না?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, সেটা জায়গা বুঝে করবে। অনেক সময় সিনেমায় কিন্তু কিছু না করাটাই অভিনয়।’ কখন সেটা নিজের থেকে বুঝতে হয়।
কৌশিক: এইটা আরও বড় একটা ট্র্যাপ। কিছু অভিনেতার ক্ষেত্রে দেখেছি, এই না করাটাকে তাঁরা ডেড অভিনয়ের দিকে নিয়ে যান। সিনেমা মানে কম করতে হবে। অনেক দিন আগে কাকুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্বাভাবিক অভিনয়টা কী? আমি যখন ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছি, তখন তো স্বাভাবিক থাকতে পারি না।
সৌমিত্র: শিশির ভাদুড়ি একবার ‘রস ও রসিক’ বলে একটা রেডিয়ো টকে বলেছিলেন যে আমি আত্মহারা হয়ে যাই না যখন রামের ভূমিকায় অভিনয় করি। তখন লব- কুশকে টেনে নিই কারণ ঠিক জায়গায় আনাটা জরুরি যাতে মঞ্চে ওরা আলোটা পায়। বলা উচিত অ্যাজ ইফ ন্যাচারাল...
পত্রিকা: আজকালকার থিয়েটারে অভিনেতাদের কাজ কেমন লাগে?
সৌমিত্র: দেবশঙ্কর হালদারের কথা বলব। সিনেমায় অপুর (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) কথাও বলব।
পত্রিকা: আর ব্রাত্য?
সৌমিত্র: মঞ্চে ওর অভিনয় দেখিনি।
কৌশিক: সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রদর্শন না করে অভিনয় করে।
পত্রিকা: এক সময় বলেছিলেন আপনাকে চিনতে গেলে আপনার সিনেমা বা কবিতা পড়তে হবে। এখনও কি সেরকম আছে?
সৌমিত্র: আগে আমার কবিতা সাবজেকটিভ ছিল। এখন কি আর সেরকম আছে?
কৌশিক: থিয়েটারের দু’টো শো-য়ের মাঝে কাকু ছবি আঁকেতেন। কবিতা লিখতেন। তার মধ্যে একটা পড়লে হয়তো কাকুকে বোঝা যাবে—
শহর ঘুমোতে গেলে মৃত মানুষেরা
নাকি জেগে ওঠে
আমাকে জাগিয়ে রাখে
অথবা কি মৃত নয়
বিচ্ছিন্ন বিরহী তারা স্মৃতি হয়ে তমসায় ডুবে আছে
শহর ঘুমাতে গেলে আমার স্মৃতির কাছে রোজ রাতে আমি অঞ্জলি পেতে রাখি
স্বাতী নক্ষত্রের জল যদি দৈবাৎ ঝরে পড়ে
অশ্রু যদি মুক্তা হয় কোনও দিন।
সৌমিত্র: হয়তো বাবান ঠিকই বলছে। |