ব্যাগ গুছিয়ে...
রাঙামাটির রাস্তা বেয়ে...
স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখাচ্ছে ঘণ্টায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার। মন ছুটছে আরও আগে। একটু আগেই আকাশ মুখ কালো করেছিল। এখন একটু পরিষ্কার হয়েছে। হাল্কা কালো কাচের আড়ালে দেখতে পাচ্ছি এন এইচ-৬-এর মসৃণ রাস্তা সরে সরে যাচ্ছে। হাইওয়ের মাঝ বরাবর যে ডিভাইডার, তার ওপর বর্ষার জল পেয়ে বেড়ে ওঠা কাঞ্চন, ফুরুস আর রঙ্গনের দল। থমকে দাঁড়ালো গাড়ি ধুলাগড় পেরিয়ে জলধুলাগড় টোল প্লাজায়। মাসুল গুনে আবার রওনা। থামলাম বাউরিয়ায়। পেটাই পরোটা ছোলার ডাল আর মাখা সন্দেশ দিয়ে সকালের টিফিন শেষ করে কুশবেড়িয়া, উলুবেড়িয়া পার করে হাইওয়ে থেকে ডান দিকে মোড় ঘুরে ঢুকে পড়লাম দেউলটির রাস্তায়।
ছুটির দিন। সবে গ্রামটার ঘুম ভেঙেছে। লোকজন বেশ আলসেমিতে ভর করে দোকানবাজার করতে বেরিয়েছে। সরু রাস্তাটার জল জমা গর্তে মোটর গাড়ির চাকার নামা আর ওঠা। জল ছিটকায়, দুধারে। পথ করে দেয় পথচলতিরা। গাড়ি রাখি এখানকার একমাত্র বিশ্রামালয়ে।
চা-শেষে পা রাখি গ্রামের পথে। কাল রাতেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। সামনের পুকুরটায় একটা শালুক। পুরোপুরি ফুটে ওঠেনি। ফুলটার খোলা পাপড়িতে কয়েকটা জলের ফোঁটা। কালো কুচকুচে একটা ভ্রমর ফুলটার ভিতরে মুখ নামাচ্ছে। ফুলটার সঙ্গে ঠিক একটা সবুজ পাতা তার গা ঘেঁষে ভেসে আছে। এগিয়ে চলি। এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ গেলে ‘সামতাবেড়’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। এ পথে শীতে যখন এসেছি তখন খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি ঝুলছে..., সকাল থেকেই চলে খেজুর রস জ্বাল দেওয়ার পালা। জ্বাল দিয়ে রস ঘন করে খেজুরগুড়, পাটালি। সে এক অন্য মজা।
এ বার এসেছি বর্ষায় ভেজা গ্রাম দেখতে। ভ্যান রিকশা চলেছে সওয়ারি নিয়ে। ক্ষণিকের ওঠা রোদ থেকে বাঁচতে সওয়ারির মাথায় ছাতা খোলা। আমি এগোই তার পিছে। বর্ষার জল পেয়ে চার পাশ বড় সবুজ। কী ভালই যে লাগছে। ডান দিকের পুকুরের জলটাও পান্না সবুজ, আকাশের রং সেখানে মিশ খায়নি। বেশ কয়েকটি নারকেল গাছ ছায়া হয়ে আছে তাতে। তারই মাঝে দেখি আলো পিছলানো সবজে গা নিয়ে জলের ওপর চোখ আর নাকটা তুলে জলের বুকে তার ছায়া সাজিয়ে একটা সোনাব্যাঙ। চুপটি করে ভেসে আছে। সামনে যেতেই এক ডুব সাঁতারে অনেকটা গিয়ে আবার ভেসে উঠল। আপনিও ওর সঙ্গে খেলায় মাতুন। ও যে দিকে ভেসে উঠছে সে দিকে যান, আবার সে ডুব দেবে। ভেসে উঠবে অন্য কোনও দিকে। আপনি আবারও সে দিক পানে।
এমনই লুকোচুরি খেলতে খেলতে নিজের ছোটবেলাটাকে আবারও ফিরে পাবেন। আমিও। নিজের মনে হাসতে হাসতে এগোই। একটা বড় ধান খেত, তিন চারটে হাঁস সেখানে। মুখ ডুবিয়ে কী যেন খেয়েই চলেছে। কোনও ব্যস্ততা নেই, নেই কোনও ছোটাছুটি, ডাকাডাকি কেবল বোহেমিয়ান দিন। এসে পড়লাম শরৎচন্দ্রের বাড়ির কাছে। এখন এ বাড়ি ‘হেরিটেজ’ আখ্যা পেয়ে একটু পরিচ্ছন্ন হয়েছে। এখানে তিনি ছিলেন ১৯২৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত। এখানেই লেখা হয়েছিল ‘বিপ্রদাস’, ‘শ্রীকান্ত’-র তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব, ও ‘পথের দাবী’-র মতো উপন্যাস।
বাড়ির উল্টোদিকেই শান বাঁধানো পুকুর। এই পুকুরেই ছিল শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত রচনা ‘রামের সুমতি’র সেই বিখ্যাত জোড়া মাছকার্তিক আর গণেশ। যাদের নাকে সোনার নোলক পরানো থাকত। বাড়ির মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই সেই প্রাচীন পেয়ারা গাছ। তার সামনে বর্মার প্যাগোডার ধাঁচে তৈরি শরৎচন্দ্রের বাড়ি। আলাপ হল দুলাল মান্নার সঙ্গে। বৃদ্ধ মানুষটি বড় ভালবেসে আঁকড়ে রয়েছেন এই স্মৃতিমেদুর বাড়িটাকে। বড় যত্ন নিয়ে বাড়ির ঘরগুলো খুলে খুলে দেখালেন। চেনালেন শরৎবাবুর ব্যবহৃত লেখার টেবিল, চটি জুতো, গড়গড়া, তাঁর হোমিওপ্যাথি ওষুধের বাক্স, রেডিও, বিশ্রামকক্ষ। প্রতিটি জিনিসই বেশ যত্ন করে রাখা। টালির চাল আর কড়ি বরগার সঙ্গে চক মেলানো মসৃণ বারান্দায় মোড়া বাড়িটার দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে নীচের গোলঘর, ঠাকুরঘর, খিড়কির দরজা, সব নজরে আসে।
এক লহমায় যেন মন চলে যায় কোন সুদূর অতীতে। চোখ বন্ধ করলে যেন অনুভব করা যায় শ্রীকান্ত আর রাজলক্ষ্মীর খুনসুটি। নেমে আসি সিঁড়ি দিয়ে। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াই তাঁর সমাধির সামনে। বাইরের ধান জমিতে তখন ধান রুইতে ব্যস্ত কৃষকের দল। একটা মেছোবক নিরাপদ দূরত্ব থেকে চোখ পাকিয়ে দেখছে তাদের। ফ্রেমবন্দি হল সবাই।
এ বার এগোতে থাকি রূপনারায়ণের দিকে। পথে পড়ল বিরামপুর কালীবাড়ি। চারপাশের সবুজের মাঝে সাদা মন্দিরটা বেশ নজর কাড়ে। মন্দিরে বিগ্রহের নিত্য পুজো হয়। মন্দিরের সামনে এক মাঠ, তাতে স্কুল বাড়ি। ছুটির দিন খেলায় মেতেছে ছোটরা। জল জমা কাদা মাটিতে চুটিয়ে ফুটবল খেলা। খেলতে খেলতে যেই বল পড়ছে পাশের পুকুরে, ওমনই সদলবলে জলে ঝাঁপ। দামালপনা। জল থেকে উঠে আবারও খেলা। কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে এগিয়ে যাই। দু’ধারে নারকেল গাছের ফাঁকে পায়ে চলা রাস্তা। পা ফেলি সে পথে। দু’পাশের ধান জমিতে ছাঁকি জাল। পৌঁছে যাই রূপনারায়ণের কূলে। নদ না নদী, সে তর্কে কাজ নেই।
নদীর ধার দিয়ে পশ্চিমে একটা রাস্তা চলে গেছে। সে পথে নিবিড় ছায়া। বাতাসের উত্তাপও যেন ছায়ায় ঠান্ডা। রূপনারায়ণের বুকে স্রোতের ঢল। দু’কূল কানায় কানায় ভরা। গভীর কতটা, পাড়ে দাঁড়িয়ে বোঝা যায় না। দূরে মাঝি লগি ঠেলে নৌকা বাইছে। গরু মোষের দল পাড়ে দাঁড়িয়ে। সবুজ গাছপালার মাথায় এখন রোদ। ধূসর আকাশের মাঝে কিছু সাদা মেঘ, ভাসছে মন্থর গতিতে। জল ধাক্কা দিচ্ছে পাড়ে, ঢেউ ভাঙছে। মনও। ঢেউয়ের মাথায় জেগে থাকা শুকনো একটা ডালে বসে দোল খাচ্ছে জল ফড়িংটা। মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে, আবারও এসে বসেছে।
নদীর পাড় ধরে এগিয়ে আসছে একটি বউ। মাথায় ঘোমটা। হাল্কা কমলা পাড়, হলুদ শাড়িতে ঢাকা গা। মাজা মাজা মুখখানি ভারি মিষ্টি, খোলা চুল ঢাকা পড়েছে ঘোমটায়। ঠোঁটে টেপা হাসি, চোখ বড় গভীর, মনের অতলেরও খোঁজ পায়। বৌটির হাতে পোষা গরুটির দড়ি, বাড়ির পথে। এ ছবি আঁকা যায় না, কেবল মনে রাখা যায়। নদী যদি ভাসিয়ে দিয়ে না যায়, তবে কোনও দিন হয়তো মন থেকে আবারও উঠে আসবে সে ছবি। ফিরতি পথে রঙ্গনের বুকে মুখ ডোবানো ছোট এক প্রজাপতি। ধরে রাখি তাকেও, ক্যামেরায়।
ফিরে আসি বিশ্রামালয়ে। ঘড়িতে তখন বেলা প্রায় আড়াইটে। দুপুরের খাওয়া শেষে কিছুটা বিশ্রাম। ফিরব বলে যখন ঠিক করেছি তখন মেঘলা আকাশের ফাঁক দিয়ে এক নরম সূর্য। গ্রামের ছেলে, বউরা পুকুরে স্নান সারছে। সারা দিনের কাজের শেষে। একটা কাঠঠোকরা এসে বসে শুকনো বাঁশের গায়ে। ছায়াগুলো সব গুটিয়ে কেমন ছোট হয়ে আসছে। একটা ঝোড়ো ঝাপটা আসছে হাওয়ার। কাঠঠোকরা পাখা মেললো। ওর ঝুঁটির লাল রংটা মিলিয়ে গেল আকাশের ধূসর ক্যানভাসে। বৃষ্টিটা বোধহয় আবারও আসছে।

কী ভাবে যাবেন
হাওড়া-খড়্গপুর ট্রেনে দেউলটি স্টেশনে নেমে ভ্যান রিকশা। পৌঁছে যাবেন গ্রামে।
অথবা গাড়িতে এন এইচ ৬ ধরে বাউরিয়া, উলুবেড়িয়া, বাগনান পার করেই ডান হাত ঘুরে
দেউলটির পথ। সকালে বেড়িয়ে সন্ধ্যায় ফিরতে পারেন। ইচ্ছা হলে এক রাত থাকতেও পারেন।
কোথায় বিশ্রাম নেবেন
আছে একটি বেসরকারি রিসর্ট। খাবারের ব্যবস্থাও আছে, ইচ্ছা হলে রাতে থাকারও।
মনে রাখবেন
শরৎচন্দ্রের বাড়ি খোলা থাকে প্রতি দিন সকাল সাতটা থেকে দুপুর বারোটা
পর্যন্ত আবার বিকেল সাড়ে তিনটে থেকে সন্ধ্যা ছ’টা।

ছবি: অঞ্জন সরকার




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.