রাসায়নিক গ্যাসের প্রকোপে সিরিয়ায় কত নারী-পুরুষ-শিশুর প্রাণ গেল? আন্দাজ বলিতেছে, প্রায় দুই হাজার। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার যাহাই দাবি করুন, ইহা যে রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগেরই দৃষ্টান্ত, তাহা লইয়া সন্দেহ চলে না। সুতরাং দ্রুত পরবর্তী প্রশ্ন উত্থাপন প্রয়োজন। ন্যূনাধিক পঁচিশ বৎসরের মধ্যে অদৃষ্ট (১৯৮৮ সালে ইরাকের হালাব্জা-য় কুর্দদের উপর রাসায়নিক অস্ত্র হানিয়াছিলেন সাদ্দাম হুসেন) এই জঘন্যতম হিংসার পর দুনিয়ার এখন কী কর্তব্য? সিরিয়ায় গত তিন বৎসর যাবৎ তীব্র মারণযজ্ঞে নিহত-আহত-গৃহহীন-শরণার্থীর প্লাবন বহিয়া যাইবার পরও যে বিশ্বসমাজ হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া আছে, এ হেন সংশপ্তক পর্বের পরও কি তাহারা নিশ্চেষ্ট থাকিবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছু কাল আগে বলিয়াছিলেন, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার ঘটিলে তিনি সমস্ত কূটনীতি-গণিত পাল্টাইতে বাধ্য হইবেন। কিন্তু তিনি কি জানেন, তাঁহাদের তূণভাণ্ডারে কী কী অস্ত্র রহিয়াছে? অর্থাৎ তাঁহারা কি জানেন যে, আসলে তাঁহাদের ভাণ্ডারে তেমন কার্যকর অস্ত্র নাই?
প্রত্যক্ষ প্রমাণ অনুসন্ধান করিতেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। তবে অনুমানে বলাই যায়, সিরীয় রাষ্ট্র ছাড়া এই নৃশংসতম কাজ কাহারও হইতেই পারে না। এত বড় কাণ্ড ঘটাইবার জন্য গ্যাস ছাড়িতে যত উৎক্ষেপণ যন্ত্র লাগে, তাহা একটি যুদ্ধযাত্রার শামিল, কোনও রাষ্ট্রশক্তি ব্যতীত তাহা সহজসাধ্য নহে। উপরন্তু, এতগুলি মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করিয়া মারিতে ‘সারিন’ নামক রাসায়নিক গ্যাসটি যে পরিমাণে লাগিবে, তাহাও কোনও রাষ্ট্র ব্যতীত কাহারও আয়ত্তে থাকা অসম্ভব না হইলেও, অসম্ভাব্য অবশ্যই। ১৯৯৫ সালে টোকিয়ো সাবওয়েতে যে গ্যাস-সন্ত্রাস হইয়াছিল, তাহাতে তেরো জনের প্রাণহানি হয়। অর্থাৎ সন্ত্রাসী, বিপ্লবী, বিরোধী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রাষ্ট্রের নজর এড়াইয়া এই বিশালাকার মনুষ্যমেধ যজ্ঞ অসম্ভব।
সিরীয় সরকারের এই মাত্রাহীন উন্মত্ততা থামানো সম্ভব কী ভাবে? কথায় অনুরোধে পরামর্শে হুমকিতে এক চুলও লাভ নাই। বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ বাড়াইয়াও লাভ নাই, কেননা উল্টা দিকে সিরীয় রাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহের জন্যও কিছু পক্ষ যথেষ্ট উন্মুখ। আর অস্ত্র সরবরাহ তো সংঘর্ষের মাত্রা কমাইবার বদলে মাত্রা বাড়াইতেই সহায়তা করিবে। সুতরাং একমাত্র পথ আক্রমণের বাস্তব ‘ডেটারেন্ট’ বা প্রতিরোধক। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামারা কি সরাসরি সামরিক অভিযান চালাইবেন? সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের বিষাক্ত ক্ষত যে পরিমাণ ছড়াইয়া গিয়াছে, তাহাতে এত দিন পর নেটো-বাহিনী সে দেশে প্রবেশ করিয়া আদৌ তাল পাইবে? তিন-তিনটি বছরের কুরুক্ষেত্রের পর প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে নামিয়া অবস্থা আয়ত্তে আনিতে সামরিক জাদুশক্তি দরকার। সেই শক্তি হানিতে পারিবে? ফ্রান্স, আমেরিকা, ইজরায়েল ছাড়া অন্যান্য দেশ এখনও দ্বিধান্বিত। রাশিয়া বিরুদ্ধভাবাপন্ন, প্রেসিডেন্ট বাশারের সমব্যথী, রাসায়নিক অস্ত্রাঘাত নিশ্চিত ভাবেই বাশার-বিরোধী বিদ্রোহীদের কাণ্ড, তথ্যপ্রমাণ-নিরপেক্ষ ভাবে মস্কো এই মতেই বিশ্বাসী। চিনও প্রত্যাঘাতের পন্থী নহে। সর্বজনমান্যতা ব্যতিরেকে পশ্চিমি সামরিক আঘাত আবার আর একটি ‘আফগানিস্তান’ হইবে না তো? আফগানিস্তান অপেক্ষা সিরিয়ার রণক্ষেত্র আরও হিংস্র বিপদসঙ্কুল। একটি ভুল চালের অর্থ সেখানে আরও রক্তের প্রবাহ, আরও অসংখ্য শিশুর আহত, নিহত ও অনাথ হইবার বন্দোবস্ত। গত বারো বৎসরে যুদ্ধাভিযান দেখিয়া ধরিত্রী ক্লান্ত, তবু সিরিয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সামরিক পদক্ষেপ ব্যতীত কোনও পথ খোলা নাই। কঠিনতর সত্য, সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ লইয়াও নারকীয়তা থামানো কঠিন। আর কঠিনতম সত্য, রাসায়নিক অস্ত্র সে দেশ হয়তো আবারও দেখিতে চলিয়াছে। |