চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
স্বপ্নের ভিতর থেকে উঠে আসা মানবীর মুখ
বিতার সঙ্গে ছবির নিবিড় সম্পর্ক আছে। দু’টি মাধ্যমই চায় দৃশ্যকে দৃশ্যাতীতে নিয়ে যেতে। লৌকিককে অলৌকিকে উন্মীলিত করতে। আধুনিক পর্ব পর্যন্ত ছবি বা ভাস্কর্য দ্বিমাত্রা ও ত্রিমাত্রায় আবদ্ধ। তাই একটি মুহূর্তে স্তব্ধ। সেই স্তব্ধতাকে জঙ্গম করে তোলাই চিত্র বা ভাস্কর্যের প্রধান দায়। এ জন্যই কবিতাকে চিত্রায়িত করা কঠিন। কিন্তু যদি তা সফল ভাবে করা যায়, তবে কবিতার কেন্দ্রীয় সত্তাকে আত্মস্থ করেই চিত্রায়ণ স্বতন্ত্র এক মাত্রায় পরিব্যাপ্ত হতে পারে।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘নীরা’ বিষয়ক কাব্যমালাকে ভিত্তি করে ৩৮ জন শিল্পীর কাজ নিয়ে সম্মেলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে। ‘কবির নীরা’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছেন গৌতম বাগচি। এ উপলক্ষে একটি সুমুদ্রিত গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনায়। তাতে প্রত্যেক শিল্পীর ছবি ছাড়া ‘নীরা’ বিষয়ে তাঁর ভাবনাও উপস্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ভাস্কর্য করেছেন স্বপন মাইতি ও রামকুমার মান্না।
‘তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা লক্ষ বছর আগে’ এ কথা যখন বলেন কবি সুনীল তাঁর ‘নীরা’ সম্পর্কে, তখন বোঝা যায় নীরা শুধু এক জন নারী মাত্র নয়। নীরা একটি সময় প্রবাহ। সেই নীরাই প্রতি মুহূর্তে হয়ে উঠেছে অসম্ভব শরীরময় এক মানবী। সেই নীরারই ‘পেস্ট না ছোঁয়া ঠোঁটে এখন ঘুম ভাঙার গন্ধ’। চিরন্তনকে এখনকার একটি মুহূর্তে বেঁধে রাখে নীরা। এই নীরাকে ছবিতে ধরা খুব কঠিন। সকলে যে পেরেছেন, তা নয়। তবে কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন। প্রায় সকলেই এঁকেছেন তাঁর নিজস্ব ভাবনার নারীর প্রতিমা। তাকে অনেক সময়ই কবির ভাবনার আলোকদীপ্তি স্পর্শ করেনি। প্রদর্শনীটির সীমাবদ্ধতা এখানেই।
শিল্পী: বিমানবিহারী দাস
ভাস্কর স্বপন মাইতি ব্রোঞ্জে গড়েছেন কবি সুনীলের মুখ। মুখের মিল একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু সেই মুখ সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারেনি কবিসত্তাকে। রামকুমার মান্না টেরাকোটায় তৈরি করেছেন লৌকিক আবহের এক তরুণী মুখমণ্ডল। তার ভিতরেই সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন নীরার অনুভব।
চারু খানের ছবিটিতে পাওয়া যায় কবির নীরার কিছু অনুষঙ্গ। শুধুই একটি মানবীর মুখ আঁকেননি তিনি। কল্পরূপাত্মক উপস্থাপনায় নীরার দূরকে নিকটের সঙ্গে মিলিয়েছেন। রবীন মণ্ডল, ফাল্গুনী দাশগুপ্ত, বিপিন গোস্বামী ও শ্যামশ্রী বসু ১৯৬০-এর দশকের এই ক’জন শিল্পী নিজস্ব আঙ্গিকে এঁকেছেন শুধুই এক মানবীর মুখ। ব্যতিক্রম নিখিলেশ দাসের ছবি। তুলির ছোপে ছায়াচ্ছন্নতার ভিতর দিয়ে এক রহস্যময় আবহ তৈরি করেছেন।
১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে হিরণ মিত্রের ছবিটি ব্যতিক্রমী। কোনও মানবীর মুখ আঁকেননি তিনি। এঁকেছেন আঁধারলীন এক বিমূর্ত পরিমণ্ডল। যার ভিতর দিয়ে ধরতে চেয়েছেন কবির বাণী:
রাত্রিময় আকাশের মিলনাম্ত নীলে
ছোট এই পৃথিবীকে করেছ অসীম
’।
বিমানবিহারী দাস রেখার নিসর্গে রূপায়িত করতে চেয়েছেন কবিতার এই আবহ ‘নদীর কোন পাড়ে তুমি নীরা, আমি নদীর মাঝখানে’। দেবব্রত চক্রবর্তী এঁকেছেন স্বপ্নের ভিতর থেকে উঠে আসা এক মানবীর মুখ। রেখার বুনোটে গড়া জহর দাশগুপ্তের ছবিতে আর্ত মানবীর শরীর ঘিরে উড়ন্ত পাখির আনাগোনা। তপন মিত্রও এঁকেছেন বেদনাক্লিষ্ট এক নারীর মুখ। ১৯৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সুব্রত চৌধুরী, শেখর কর, প্রদীপ রক্ষিত, তাপস সরকার প্রমুখ। অভিব্যক্তিবাদী অনুষঙ্গে সকলেই মানবীর অন্তর্লোককে উন্মীলিত করতে চেষ্টা করেছেন। অর্চনা দাস এঁকেছেন এ রকম দৃশ্যপ্রতিমা: ‘নীরা আছে জলে, হাঁসগুলি ভেসে চলে, নীরাকে ঘিরে’।
পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে গৌতম মুখোপাধ্যায়ের ছবিটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্বাভাবিকতায় স্বপ্ন ও বাস্তবের সমন্বয়ের কারণে। সুজাতা চক্রবর্তী এঁকেছেন নদীর নিসর্গে বসে থাকা বর্ণিল লৌকিক মানবী প্রতিমা। রাখী রায় এঁকেছেন ধ্যাননিমগ্না এক মানবীর ছবি। রবীন রায়ের ছবিটি অন্য রকম। এক পুরুষের মুখাবয়বে ছড়িয়ে আছে নারীর অজস্র ঠোঁটের স্পর্শ। রত্না চৌধুরী এঁকেছেন লৌকিক সারল্যে এক নারীর মুখের পার্শ্বচিত্র। সুমনা ঘোষের টেম্পারায় আঁকা ছোট ছবিটিতে ভাবনার গভীরতা ছিল। ছবিটি কেন বইতে ছাপা হয়নি, বোঝা গেল না। এছাড়া অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন কৃষ্ণধন আচার্য, সুবুদ্ধ ঘোষ, সুমন কবিরাজ, দেবব্রত ঘোষ, তন্ময় রায়চৌধুরী, রূপচাঁদ কুণ্ডু প্রমুখ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.