অপরাধের গুরুত্বের নিরিখে নয়। পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ ঝান্ডার রং দেখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে মনে করছে কলকাতা হাইকোর্ট। বৃহস্পতিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা থানার একটি মামলার শুনানির সময়ে এমনই অভিমত প্রকাশ করেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
মামলাটি হল হত্যা-তদন্তে পুলিশি গাফিলতির অভিযোগ সংক্রান্ত। গড়বেতা থানার আমলাগোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী ছিলেন নিমাই দুলে। তিনি ভোটে জিতেছেন। কিন্তু নির্বাচনের দু’দিন পরে নিমাইবাবুর ভাই গণেশ দুলে খুন হয়ে যান। পুলিশ ক’দিন বাদে মূল অভিযুক্তদের দু’জনকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ, আদালতে হাজির করানো হলে পুলিশ অভিযুক্তদের নিজেদের হেফাজতে রাখার আবেদন করেনি। ফলে তাদের জেল হেফাজতে পাঠানো হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন গণেশবাবুর মা, স্ত্রী ও ভাই। তাঁরা হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত করারও আবেদন জানিয়েছেন।
সেই মামলারই শুনানি ছিল এ দিন। সেখানে খুনের মামলার প্রধান অভিযুক্তদের পুলিশ নিজের হেফাজতে নিতে না-চাওয়ায় পুলিশি ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষুব্ধ বিচারপতির কথায়, “পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অনেক মামলা হচ্ছে। সেগুলি পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে, পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছে না। তারা কাজ করছে রাজনৈতিক দলের রং দেখে। ঝান্ডা দেখে।” বিচারপতির বক্তব্য: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অভিযোগ গুরুতর না-হলেও পুলিশ মূল অভিযুক্তদের নিজের হেফাজতে নিচ্ছে। আবার খুনের মামলার অভিযুক্তকে জেল হেফাজতে পাঠানোর আর্জি জানাচ্ছে, পুলিশি হেফাজত চাওয়া হচ্ছে না। “সব ক্ষেত্রে পুলিশ একই রকম ভূমিকা পালন করছে না। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।” মন্তব্য করেছেন বিচারপতি। |
পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অনেক মামলা হচ্ছে। সেগুলি
পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে, পুলিশ নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছে না।
তারা কাজ করছে রাজনৈতিক দলের রং দেখে। ঝান্ডা দেখে।
সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারপতি, কলকাতা হাইকোর্ট |
|
গণেশবাবুর পরিবারের কৌঁসুলি অনিন্দ্য লাহিড়ী এ দিন সওয়ালে অভিযোগ করেন, মামলার আরও দুই অভিযুক্ত অরূপকুমার ওরফে বাচ্চু ও ধনঞ্জয় সরকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করেনি। পরিবারটি তাই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। বিচারপতি সব শুনে বলেন, “পুলিশের এই জাতীয় কাজের ফলে তাদের উপরে আর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক রং দেখেই পুলিশ কাজ করছে।” গণেশ দুলের পরিবারের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট পরিষ্কার জানিয়েছে, যদি ওই পরিবারের কেউ আক্রান্ত হন, তা হলে আদালত চুপ করে থাকবে না।
এ দিকে বিচারপতির এ হেন কঠোর মন্তব্যের পিছনে রাজ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট দেখছেন আইনজীবীদের একাংশ। এই মহলের মতে, বামফ্রন্ট আমলের ট্র্যাডিশনই বর্তমান জমানায় বহাল রয়েছে। অনুব্রত থেকে মাজদিয়া উদাহরণ হিসেবে উঠে আসছে এমন বিভিন্ন প্রসঙ্গ। কী রকম?
ওঁরা বলছেন, বীরভূমের জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে পুলিশ যে ধারায় মামলা দায়ের করেছিল, তা বিচারক মেনে নিতে পারেননি। পরে তিনি নিজেই মামলায় নতুন ধারা যুক্ত করেন। কিন্তু তার পরেও পুলিশ অনুব্রতবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি বলে অভিযোগ। আবার কামদুনি-মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন নিয়ে সিআইডি-কে রীতিমতো ভর্ৎসনা করেছেন বিচারক। আইনজীবীদের একাংশের দাবি: রায়গঞ্জে কলেজে ভাঙচুর ও অধ্যক্ষ নিগ্রহে শাসকদলের ছাত্রনেতাদের জামিন মঞ্জুর হলেও একই রকম অভিযোগে মাজদিয়ায় বিরোধী ছাত্রনেতাদের জেলে পাঠিয়েছিল বর্তমান সরকার। বৈষম্যের অভিযোগ উঠতেও দেরি হয়নি।
এ দিন বিচারপতির পর্যবেক্ষণের পিছনে এ সবেরই ছায়া দেখছেন আইনজীবীদের অনেকে। মহাকরণে স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা অবশ্য বিচারপতির অভিমত সম্পর্কে মুখ খুলতে চাননি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও বলেন, “বিচারপতির মতামত নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।” সাত দিন পরে মামলাটির শুনানি। বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, সে দিন শুনানির সময়ে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) বিমল চট্টোপাধ্যায় ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনজিৎ সিংহকে হাজির থাকতে হবে। |