জীবিত নরেন্দ্র দাভলকর আঠারো বছরের নিরলস চেষ্টায় যাহা পারেন নাই, নিহত নরেন্দ্র দাভলকর তাহা কার্যত রাতারাতি সাধন করতে চলিয়াছেন। কুসংস্কার ও কুপ্রথা নিষিদ্ধ করিতে মহারাষ্ট্রে অর্ডিনান্স জারি হইবে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামী সমাজকর্মী নরেন্দ্র দাভলকর এই আইন প্রণয়নের জন্য মহারাষ্ট্রের সরকার তথা রাজনীতিকদের উদ্যোগী করিবার জন্য দুই দশক যাবৎ নিরলস চেষ্টা চালাইতেছিলেন। তাঁহার এই সংগ্রামে কুসংস্কার ও কুপ্রথার কারবারিদের স্বার্থে আঘাত লাগিয়াছিল। স্বাভাবিক ভাবেই দাভলকর হুমকি শুনিয়াছিলেন। প্রাণনাশের হুমকিও। রাজ্য সরকার তাঁহাকে পুলিশি নিরাপত্তা দিতেও চাহিয়াছিল। দাভলকর সবিনয় তাহা প্রত্যাখ্যান করেন। এই ধরনের সংগ্রামী মানুষ সাহসী হইয়া থাকেন। দুঃসাহসীও। অনেক সময়েই তাহার মূল্য দিতে হয়। দাভলকর চরম মূল্য দিলেন। এবং অর্ডিনান্সের প্রস্তুতি শুরু হইল।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দাভলকরের মৃত্যুকে গাঁধী-হত্যার সহিত তুলনা করিয়াছেন। আততায়ীদের ধরিতে পারিলে দশ লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করিয়াছেন। প্রসঙ্গত, এই বিষয়ক আইন-প্রস্তাবটি মহারাষ্ট্রের বিধান পরিষদে পাশ হইয়াও বিধানসভায় পেশ হওয়ার অপেক্ষায় পাঁচ বছর ধরিয়া হিমঘরে প্রতীক্ষমাণ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আগামী শীতকালীন অধিবেশনে বিলটিকে আইনে পরিণত করার আশ্বাস দিয়াছিলেন। রাজ্যের দুই প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিজেপি ও শিবসেনা উভয়েই বিলটির বিরোধী। নিহত দাভলকরের প্রতি সহানুভূতির হাওয়ায় অর্ডিনান্সটি ভাসাইয়া দিয়া বিরোধীদের বিপাকে ফেলা যাইবে, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো এমন অঙ্ক কষিয়াছেন। রাজনীতির পরীক্ষায় ‘কমন’ অঙ্ক।
দাভলকর ঈশ্বর, দেবতা, ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা ধর্মাচরণের বিরোধী ছিলেন না। বরং তিনি মনে করিতেন, ইচ্ছা মতো ধর্মাচরণের সাংবিধানিক অধিকার দেশের সকল নাগরিকেরই আছে। কিন্তু ধর্মের নামে যে সকল কুসংস্কার সমাজে বাসা বাঁধিয়া আছে, ধর্মগুরুদের যে বিস্তৃত কাঠামো নিজেদের ঐশ্বরিক মহিমা ও আধ্যাত্মিকতায় মণ্ডিত করিয়া বিশ্বাসী ও অজ্ঞ জনসাধারণের কাছে আনুগত্য দাবি করে, তিনি তাহার বিরোধিতা করিতেন। বিরোধিতা করিতেন সেই সব তথাকথিত ধর্মীয় প্রথা ও আচরণেরও— মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য দেবতার কাছে পশু কিংবা নরবলি দেওয়া, চিকিৎসার নামে ভূত-তাড়ানো, প্রেতাত্মাকে তুষ্ট করার ওঝাগিরি, দামি পাথর ধারণ, কবচ পরিধান ইত্যাদি— যাহা দুর্জ্ঞেয়বাদের ধারক, ক্ষতিসাধকও। এই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বিবিধ দুরাচারের মুখোশ খুলিয়া দিতে দায়বদ্ধ ছিলেন। দাভলকর যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের এক মহান ঐতিহ্যের উত্তরসাধক। অন্ধ ধর্মীয় কুসংস্কারের দ্বারা পীড়িত, প্রতারিত ও শোষিত দরিদ্র জনসাধারণের দুর্গতি ঘুচাইতে বরাবরই এই আন্দোলনের সৈনিকরা সাহসের সহিত অগ্রসর হইয়াছেন। এবং রক্ষণশীলতার প্রহরীদের দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছেন। দাভলকরের উপর কেবল যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কারবারিরা ক্ষিপ্ত হইয়াছিল, তাহা নয়, হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি, সনাতন সংস্থা, এমনকী খাপ পঞ্চায়েতও সংঘবদ্ধ হইয়াছিল। দাভলকরের জীবন শেষ হইয়াছে, তাঁহার সংগ্রাম এখনও অনেক বাকি। |