কর্মসংস্কৃতি শব্দটি বাঙালির অতিপরিচিত, কিন্তু শব্দার্থটি তাহার অচেনা। বাঙালির দোষ নাই, দীর্ঘ অনভ্যাসে বিস্মৃতি স্বাভাবিক। কাজ না করিবার ব্যাধিটি সর্বব্যাপী, কিন্তু সরকারি দফতরে তাহার প্রকোপ মারাত্মক। কারণ, কাজ না করিলেও জবাবদিহি করিবার কোনও দায় সেখানে নাই। বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বৎসর অতি যত্নে এই দায়হীনতা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। দলের প্রতি, কো-অর্ডিনেশন কমিটির প্রতি নিষ্ঠা থাকিলেই চলিত, কাজের হিসাব রাখিবার বালাই ছিল না। সত্য বটে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘এখনই করুন’ স্লোগানের জনক, কিন্তু তিনিও মন্ত্রীদের অকর্মণ্যতা লইয়া কয়টি শব্দ খরচ করিয়াছিলেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দীর্ঘ নীরবতা ভাঙিয়াছেন। তিনি মন্ত্রী, আমলাদের ডাকিয়া কাজের হিসাব লইয়াছেন, গাফিলতির জন্য তিরস্কার করিয়াছেন, কী ভাবে কাজ করিতে হইবে, সেই পথ ছকিয়া দিয়াছেন। এবং জানাইয়াছেন, ইহার পরেও যদি কাজ না হয়, তবে পদ হইতে সরিতে হইবে। তাঁহার ধমকে আদৌ কাজ হইবে কি না, রাজনীতির পাটিগণিত প্রশাসনিক কুশলতা অর্জনের পথে বাধা হইয়া দাঁড়াইবে কি না— প্রশ্নগুলির উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু ‘প্রথা’ ভাঙিয়া কাজের হিসাব চাহিবার পিছনে যে চিন্তা, তাহার মূল্য অনস্বীকার্য। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্য মহৎ।
উদ্দেশ্য মহৎ হইলেও উদ্দেশ্য সাধনের পথ অভ্রান্ত না হইতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী যে ভঙ্গিতে কর্মসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করিতে তৎপর, তাহা লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে। মন্ত্রী এবং আমলা, উভয় পক্ষকেই তিনি পরস্পরের সম্মুখে তিরস্কার করিয়াছেন। কাজটি সুবিবেচনার পরিচয় দেয় কি? সরকারি প্রশাসনের একটি বিশদ কাঠামো আছে, সেখানে বিভিন্ন স্তরের মধ্যে উচ্চাবচ সম্পর্ক থাকে, সেই সম্পর্কে ‘স্বচ্ছতা’ সতত বাঞ্ছনীয় না-ও হইতে পারে। প্রকাশ্যে বকাবকির এমন প্রতিক্রিয়াও হইতে পারে যাহাতে জবাবদিহির প্রকল্পটিই হয়তো বিফলে যাইবে। তেমন পরিণতি অতি দুর্ভাগ্যের হইবে। তিরস্কার করিবার প্রকৃষ্ট পন্থা কী, পরিসরই বা কোনটি, মুখ্যমন্ত্রীকে ভাবিতে হইবে। প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্রলক্ষণ স্পষ্ট— তিনি বহু ক্ষেত্রেই পরিণাম না ভাবিয়াই কথা বলেন, যাহাতে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, এবং বহু সদর্থক চিন্তাও শেষ পর্যন্ত হারাইয়া যায়। এই অভ্যাসটি ছাড়িতে পারিলে তাঁহার মঙ্গল। দুই বৎসর কাটিবার পর যখন তিনি প্রশাসনের দিকে তাকাইবার সময় পাইয়াছেন, তখন অবিবেচনার জালে জড়াইয়া সেই সুযোগটি নষ্ট না করিলেই ভাল হয়।
এহ বাহ্য। প্রশাসনের কুশলতাবৃদ্ধির কথা যখন ভাবা হইতেছে, তখন আরও গভীরে যাওয়া বিধেয়। এই রাজ্যে এমন কিছু মূলগত সমস্যা রহিয়াছে, যাহার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত কুশলতায় পৌঁছানো সম্ভব হইবে না। আপাতত একটি সমস্যার কথা আলোচনা করা যায়। এই রাজ্যের মন্ত্রিসভা বিপুলায়তন। যথাসম্ভব অধিক সংখ্যায় মন্ত্রী নিয়োগ করিবার এই রীতি বামফ্রন্ট আমলেও ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই জমানার অনেক উত্তরাধিকারের মতোই এটিও সযত্ন বহন করিতেছেন। এই বাহুল্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। প্রমাণ: গুজরাত। সেই রাজ্যের বিধানসভায় মোট ১৮২টি আসন, মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ রাখিলে পূর্ণমন্ত্রীর সংখ্যা সাত। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভায় আসন ২৯৫টি, পূর্ণমন্ত্রী ৩৭ জন। বিধায়কসংখ্যার অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গে পূর্ণমন্ত্রীর সংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ১১.৩ জন— বাড়াইয়া বড়জোর ১২ জন। জনসংখ্যার অনুপাতে আরও কম— মাত্র সাড়ে দশ। সাত জন পূর্ণমন্ত্রী যদি গুজরাতে প্রশাসন চালাইতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গে ৩৭ জনের প্রয়োজন হইবে কেন? এমন বহু ক্ষেত্র আছে, যেখানে মন্ত্রিসভা নীতি নির্ধারণ করিয়া দিলে বাকি কাজ প্রশাসনিক ভাবেই চলিতে পারে, মন্ত্রীর প্রয়োজন হয় না। সেই মন্ত্রীদের ছাঁটিয়া ফেলুন। জরুরি সিদ্ধান্ত লইতে হইলে মুখ্যমন্ত্রী তো আছেনই। |