রাতে বাড়ি ফিরে মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খেতে হয় তাকে।
তার পর তিন-চার ঘণ্টা ঘুমিয়েই ভোর ভোর কলকাতা।
বাচ্চাদের সামলে, কলকাতায় এসে বাবুর জলখাবার, বুবাইয়ের টিফিন, বৌদিমণির চা, মাইমার ধোঁকার ডালনা বানিয়ে সন্ধ্যের ট্রেনে আবার বাড়ি ফেরে সে। ‘নয়নচাঁপা’। থাকে সে শহরতলিতে।
গত কয়েক দিন সেই নয়নচাঁপার জীবনে সামান্য একটু বদল এসেছে। না, কাজ করা তার কমেনি, কিন্তু টলিউডের অন্যতম সফিস্টিকেটেড অভিনেত্রী এ বার তার মতোই ঘর মোছেন। ঝাঁট দেন। স্বামীর অত্যাচার সহ্য করছেন।
রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। থাকেন তিনি গল্ফ গার্ডেনে।
শেখর দাসের পরের ছবিতে কাজের মেয়ে নয়নচাঁপা হয়ে উঠেছেন রূপা।
ছোট পরদার মহারানি দ্রৌপদী আজ বড় পরদায় অভিনয় করছেন এমন এক চরিত্র যার জন্য তিনি নাকি বহু বছর অপেক্ষা করেছেন।
নিজের চারপাশটা দেখেছেন আর ভেবেছেন যদি ও রকম একটা চরিত্র কোনও দিন কেউ তাঁকে দেয়... যে নিজে যতটা নির্যাতিত, সুযোগ পেলে নিজেও ততটাই নির্যাতন করে। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে পোড় খাওয়া সে। নয়নচাঁপা সেই শ্রেণির মানুষের একজন যারা ভোর তিনটের সময় লোকাল ট্রেনে করে কলকাতায় আসে। তার পর সারা দিন কারও বাড়ি ঠিকে ঝি বা রান্নার মাসির কাজ করে। মাঝে হয়তো কোনও বাড়ির বাবুর লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়। বা হয়তো তাতে স্বেচ্ছায় রাজিও হয়ে যায়। দাদাবাবুর জলখাবার, বুবাইয়ের টিফিন, বৌদিমণির চা আর মাসিমার ধোঁকার ডালনা রান্না সেরে সন্ধ্যার ট্রেনে আবার বাড়ি ফেরে। তার পর চলে মাতাল স্বামীর অত্যাচার। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে স্বামীরা তো মদ খেয়ে একটু আধটু মারেই! বাচ্চা, বাড়ি সামলানো। তিন-চার ঘণ্টা ঘুম। ভোর হলেই আবার রুটিন শুরু। রোজকারের এই দিনলিপির মধ্যে সে হয়তো নানা রকমের ভাল, মন্দ সব রকমের কাজ করে। তবে যাই করুক না কেন, সব কাজের পিছনে তার নিজের একটা যুক্তি আছে। |
সারাদিনের শ্যুটিংয়ের পরে গল্ফ গার্ডেনের নিজের বাড়িতে রূপা যখন ফিরলেন, তখন সেখানে এক হাঁটু জল। প্রায় সাঁতরে বাড়িতে ঢোকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। লিফ্ট কাজ করছে না। এমনকী মঙ্গলবার সকালে শ্যুটিংয়ের সময় পাটুলির ফ্ল্যাটের লিফ্টটাও একেবারে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির স্রোতে জল ঢুকে গিয়েছিল সেখানে। “জানেন, আমার খুব ইচ্ছে ছিল এই চরিত্রে অভিনয় করার আগে দশ দিন বোলপুরে গিয়ে রোদে পুড়ে আসব। গায়ের রংটা তা হলে একদম ন্যাচারালি পোড়া লাগত। কিন্তু যে রকম বৃষ্টি হচ্ছে! কী করে সম্ভব? তাই পারলাম না। মেক আপ করে ঠিক করতে হল,” বলেন রূপা।
বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মেক আপ পুরো তোলা হয়নি। পরনে লাল টি-শার্ট আর কেপ্রি। সিঁথিতে সিঁদুর। হাতে একটা লোহা। আঙুলে লোহার আংটি। আর টিপিকাল কাজের মাসিদের পছন্দসই একটা বেগুনি পাথর বসানো নাকছাবি। অদ্ভুত কম্বিনেশন। একটা বৈপরীত্যের সহাবস্থান। কেন এমন একটা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে ছিলেন তিনি? ইদানিং তো তাঁকে দেখা যাচ্ছিল সফিস্টিকেটেড মহিলাদের চরিত্রে। কীসের তাগিদে নিজেকে এ ভাবে ভাঙতে চাইলেন তিনি? “কোথাও যেন একটা মোনোটনি এসে যায়। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারি একটা চরিত্র করার জন্য। ম্যানারিজম, ডিটেলিং, এ সব আমি করব। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা দরকার যে স্ক্রিপ্টটা আমাকে কতটা সাহায্য করছে,” বলেন তিনি।
তার পর ফিরে যান তাঁর টেলিভিশনের গোড়ার দিকের কথায়। বলেন, “আমি একটা নন-অ্যাক্টিং করে অ্যাক্টিং করার চেষ্টা করতাম।
মনে আছে, অভিজিৎ দাশগুপ্তের ‘ইঙ্গিত’ বলে একটা কাজে আমি বাড়ির বড়দির চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। জীবনের প্রথম দিকে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি ‘মুক্তবন্ধ’তে। আমার তখন হয়তো ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স হবে। আর অভিনয় করলাম পঞ্চান্ন বছরের এক চরিত্রে। রিংগোর একটা শর্ট ফিল্মে পাগলের রোল করেছিলাম। এক লেসবিয়ানের চরিত্রেও অভিনয় করেছিলাম কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের টেলি-ছবি ‘একটু উষ্ণতার জন্য’। যে দিন টেলিভিশনে দেখানো হল, প্রায় রাত দু’টো পর্যন্ত আমার ল্যান্ডলাইনটা বেজেছিল। কত দর্শকের ফোন পেয়েছি। তখন তো আর মোবাইল ছিল না। তাই ল্যান্ডলাইনে ফোন আসত। আজও কত মানুষ ওই কাজগুলোর কথা মনে রেখেছেন।” থিয়েটারের ট্রেনিং ছিল না কোনও দিনই। খানিকটা নিজের থেকে আর বাকিটা অন্য অভিনেতাদের থেকে দেখে দেখে অভিনয় শৈলীটা শিখেছেন তিনি। “সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিখেছিলাম কী করে ন্যাচারালি কেঁদে ফেলতে হয়। দুঃখ পেলে প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা রি অ্যাকশন হয়। কারও মাথা দপদপ করে।
আমার নাকের ডগাটা লাল হয়ে যায় আর ব্যথা করতে থাকে। আর ঠিক তখন বুঝতে পারি আর ঠিক কত সেকেন্ড পর চোখ থেকে জল পড়বে। আর এই সময়টা বুঝে অভিনয় করলেই তো স্বাভাবিক ভাবে কান্নাটা আসবে।” ‘মহাভারত’ করার সময় একবার রূপাকে নাকি বলা হয়েছিল পনেরো মিনিটের তফাতে দু’টো একদম বিপরীতধর্মী আবেগ প্রকাশ করতে। প্রথমে অট্টহাসি। আর তার ঠিক পনেরো মিনিট পর ফুঁপিয়ে কান্না। আর সেটাই তিনি সেট-এ করে দেখিয়েছিলেন। “এত বছরের কেরিয়ারে আমি অনেককে দেখে অভিনয়টা রপ্ত করার চেষ্টা করেছি। মাধবীদি, সৌমিত্রদাকে খুব খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি। রীনাদি, গৌতমদা (ঘোষ) আর ঋতু আমাকে হাত ধরে শিখিয়েছে। শাবানা আজমির থেকে শিখেছি। মনে আছে যখন ‘মহুলবনীর সেরেঞ্চ’ করলাম, শেখর আমাকে বলেছিল টেলিভিশন থেকে রপ্ত করা ছকবাঁধা অভিনয় কৌশলটা একেবারে ভেঙে ফেলতে। গড়গড় করে কথা বলতে। তাই করলাম।” |
শেখরের সঙ্গে চার নম্বর ছবিটা করতে এসে নিজেকে আবার ভাঙছেন তিনি। “আমার বাড়িতে কিছু দিন আগে একজন কাজ করতে এসেছিল। যত বলি দেওয়ালে ও ভাবে ঠেস দিয়ে দাঁড়াস না, কে কার কথা শোনে! ঠিক ঘরে ঢুকে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলত: ‘বৌদি, ভাত বেনেছি, ডাল বেনেছি, বেগুনপোড়া বেনেছি’। তার মাঝে আবার এক আধ বার শরীরের আঁচলটা খসে যায়,” বলেই আবার সেই মেয়েটির গলাটা নকল করে দেখালেন। তার পর বলেন, “আমি তো ওর এই আঁচল খসে পড়াটা নকল করে দেখিয়েছি আমার বন্ধুদের।”
এই সব টুকরো টুকরো স্মৃতি মিশিয়েও নয়নচাঁপাকে গড়ে তুলছেন রূপা। সম্প্রতি অবশ্য ‘সাব-অল্টার্ন’ চরিত্রদের নিয়ে বাংলা সিনেমাতে বেশ চর্চা চলছে। তবে এই শ্রেণির মানুষদের নিয়ে বড় পরদায় এর আগেও বেশ ভাল কাজ হয়েছে। সুদীপ্তা চক্রবর্তী ‘বাড়িওয়ালি’তে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন এমনই একটি চরিত্র করে। শেখর নিজে ভুলতে পারেন না রোহিণী হাতাঙ্গাডির অভিনয়। ‘অর্থ’ ছবিতে এই রকম এক বাঈয়ের ভূমিকায়। “এই মুহূর্তে সে রকম কোনও চরিত্রের কথা ভেবেছি সেটা হয়তো নয়। পনেরো দিনের শ্যুটিংয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। স্ক্রিপ্টটা আমি লিখিনি। আমি সম্পূর্ণ ভাবে আমার পরিচালকের উপর নির্ভর করছি এখানে। নিজে সিনেমার টেকনিক্যাল দিকটা বুঝি। কিন্তু এখানে একবারও ভাবছি না ক্যামেরার সামনে কোন অ্যাঙ্গেলে দাঁড়ালে আমাকে ভাল লাগবে,” বলছিলেন রূপা।
রূপাকে সত্যিই দেখতে একেবারে অন্যরকম লাগছে। নখের ডগায় কালি। শ্যুটিং চলাকালীন কোনও শ্যাম্পু নয়। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। তিন কেজি ওজন কমিয়েছেন এর মধ্যে। স্বীকার করছেন যে তাঁর সহ-অভিনেত্রী চান্দ্রেয়ী আর দামিনী এতটাই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন যে, তাঁর অভিনয় করতে একটু ভয়ও লাগছে। “নাম করার উচ্চাশা আমার কোনও দিনই ছিল না। আমার বিরক্ত লাগে বেশি কাজ করতে। এ রকম তো লাক্সারি নেই যে আমি দু’তিন বছর বসে থেকে তার পর একটা ভাল কাজ করব। তবে দু’চার বছর ধরে সমালোচকদের আমার সম্পর্কে লেখার একটা প্যাটার্ন দেখে সেটার সম্পর্কে মন্তব্য না করে পারছি না। প্রায়ই দেখি লেখা হয়: ‘রূপা তো ভাল অভিনেত্রী, উনি ভাল-ই করবেন!’ আমার মনে হয় ভাল বা খারাপ, যা-ই লেখা হোক, বিশ্লেষণ করা উচিত। ”
নয়নচাঁপার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দেখে সমালোচকরা হয়তো সতর্ক হয়েই লিখবেন, কাজের মেয়ের ভূমিকায় রূপা... |