দু’দিনের টানা বৃষ্টি ফের বুঝিয়ে দিল হাওড়া রয়েছে সেই তিমিরেই।
একটু বেশি বৃষ্টি হলে যে জলছবি প্রায় প্রতি বছর ফিরে আসে, সেই ছবির পুনরাবৃত্তি হল এ বারও। নিকাশি ব্যবস্থার কোনও উন্নতি না হওয়ায় সোমবার ও মঙ্গলবারের টানা বৃষ্টিতে ভাসল হাওড়া, বালি এবং উলুবেড়িয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। বাদ গেল না মহাকরণের নতুন ঠিকানা এইচআরবিসি ভবন সংলগ্ন রাস্তাও। জল জমল ওই ভবনের প্রধান ফটকের সামনে ক্ষেত্র ব্যানার্জি লেনে। তবে জল যাতে আর না জমে, সে জন্য ইতিমধ্যে রাস্তার একপাশে নর্দমা করে সেই নর্দমার জল কিছুটা দূরে হাইড্রান্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এইচআরবিসি-র ইঞ্জিনিয়ারেরা। |
|
|
হাওড়ার মন্দিরতলায় এইচআরবিসি ভবনের
সামনে জমে আছে জল। |
চেঙ্গাইলের দৈবখালি গ্রামে
এ ভাবেই চলছে পানীয় জল সংগ্রহ। |
|
হাওড়া পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু’দিনের বৃষ্টিতে জল জমে সেখানকার ৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০টিতে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহরের নিচু এলাকাগুলি। যেমন উত্তর হাওড়ার লালবিহারী বোস লেন, মহীনাথ পোড়েল লেন, দশরথ ঘোষ লেন, নস্করপাড়া রোড। বেলগাছিয়া এলাকার বহু বাড়িতে জল ঢুকেছে। হাঁটু জলে ডুবে যায় বেনারস রোড। যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ভয়াবহ অবস্থা হয় জায়সবাল ও সত্যবালা হাসপাতালের কাছে শহরের ‘লাইফলাইন’ জিটি রোডের। একেই বড় বড় গর্ত, তার উপরে প্রায় হাঁটুসমান জল জমে তৈরি হয় মরণফাঁদ। জল জমে যায় সত্যবালা হাসপাতালের ভিতরেও। জমা জলে প্রাণান্তকর অবস্থা হয় উত্তর হাওড়ার নস্করপাড়া বস্তি, বেলগাছিয়া বস্তি ও মধ্য হাওড়ায় কাঁকড়াপাড়া বস্তির বাসিন্দাদের। নিচু জমিতে বস্তির ঘরগুলি প্রায় তিন ফুট জলের তলায় চলে যায়।
প্রতিবারের মতো এ বারও টানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে হাওড়া পুরসভার সংযুক্ত ওয়ার্ডের নিচু এলাকাগুলি। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, সংযুক্ত ওয়ার্ডগুলির মধ্যে ৪৪ থেকে ৫০ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় কোমরসমান জল জমেছে ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের ভুতবাগান ও ভোটবাগানে।
হাওড়া পুরসভার মেয়র মমতা জায়সবাল বলেন, “অবস্থা খুব উদ্বেগজনক। পুরসভার ১৮ থেকে ২০টি ওয়ার্ড জলমগ্ন। বৃষ্টি না থামলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ইতিমধ্য শহরের সব নিচু জায়গা প্লাবিত হয়েছে। পুরসভার ২৮টি পাম্পের মধ্যে ১২টি চালানো হচ্ছে। জল জমে থাকায় বাকি পাম্পগুলি চালানো যাচ্ছে না।” জমা জল না নামার কারণ হিসেবে মেয়রের দাবি, গঙ্গার জলস্তর উঁচুতে থাকায় এবং পূর্ণিমার জন্য বড় জোয়ার আসায় জল নামতে পারছে না। ভাটা পড়লেই জল নামতে শুরু করবে।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সমস্ত অফিসারদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। নিকাশি ও সাফাই দফতরের দুই অফিসারকে ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল-রুমে থাকতে বলা হয়েছে। শহরের পরিস্থিতি দেখতে মঙ্গলবার বিকেলে সপার্ষদ মেয়র উত্তর হাওড়ার বিভিন্ন জলমগ্ন এলাকায় যান। পরে তিনি অভিযোগ করেন, উত্তর হাওড়ার বিভিন্ন অংশ জল দাঁড়িয়ে থাকার কারণ রেল রানিঝিল সংস্কার না করে রেল ইয়ার্ডের জমা জল পাম্প করে ফকিরপাড়া, মহীনাথ পোড়েল লেন এবং দশরথ ঘোষ লেনে ফেলছে। তাই এত বৃষ্টিতেও এ বার রেল ইয়ার্ডে জল জমেনি। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ডিআরএম অনির্বাণ দত্ত। তিনি বলেন, “কে কী অভিযোগ করছেন, তার উত্তর দেব না। কী হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।”
রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “হাওড়ায় কেএমডিএ তিনটি পাম্পিং স্টেশন করতে চেয়েছিল। কিন্তু হাওড়া পুরসভার বাধায় সিইএসসি বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়নি। ওই তিনটি পাম্পিং স্টেশন চালু হলে এত জল জমত না। এ ছাড়া, হাওড়া পুরসভা নিয়মিত পলি তোলা থেকে শুরু করে নিকাশির সংস্কার কোনও কাজই করেনি।” মন্ত্রী জানান, হাওড়ায় নতুন মহাকরণের সামনে জল জমার সমস্যা পুরসভা সমাধান না করলে রাজ্য সরকারই তা করবে।
নিকাশি সমস্যার জেরে বৃষ্টিতে জলমগ্ন বালি পুরসভা এবং বালির পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকাও। বালি পুর এলাকার ৩৫টি ওয়ার্ডে কমবেশি জল জমে রয়েছে। বেশ কয়েকটি স্কুলে জল ঢুকেছে। বালির গোস্বামীপাড়া, ডিংসাইপাড়া, পাঠকপাড়া, শান্তিরাম রাস্তা, বেলুড় খামারপাড়া, স্টেশন রোড, ভোটবাগান, লিলুয়া রেল কলোনি। এ ছাড়াও জল জমেছে লিলুয়ার মীরপাড়া, নেতাজি সুভাষ রোড, রবীন্দ্র সরণি, ভট্টনগর, গোশালা রোডে। বালির পঞ্চায়েত এলাকার মধ্যে সাঁপুইপাড়া বসুকাঠি, আনন্দনগর, ঘোষপাড়া, নিশ্চিন্দা এলাকাও জলমগ্ন।
বালি পুরসভার দাবি, এলাকার সমস্ত নিকাশি নালাগুলিই হয় পঞ্চায়েতের খালের সঙ্গে যুক্ত, কিংবা কোনও ঝিলের সঙ্গে। এই খাল বা ঝিলগুলি সংস্কার হয়নি। ফলে রাস্তার জমা জল সরানো যায়নি। উল্টে জল উঠে আসছে রাস্তায়।
জল জমেছে উলুবেড়িয়া পুরসভার ৭, ৯, ১৭, ১৮ এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডেও। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫টি গ্রামের মানুষ জলবন্দি। ফলে, পুরসভার প্রতি তাঁদের ক্ষোভ বাড়ছে। পুরসভার ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে চেঙ্গাইলের বেশ কিছু গ্রাম। জল জমে যাওয়ায় এখানে বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা, ব্যাঙ্ক ও দোকানপাট। অনেক বাড়িতে জল ঢুকেছে। পানীয় জলের কলগুলিও জলের তলায়।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুরসভা দীর্ঘদিন নিকাশি ব্যবস্থার দিকে নজর না দেওয়াতেই এই সমস্যা। চেঙ্গাইলের দৈব্যখালির বাসিন্দা হায়দার আলি গুরে বলেন, “আমরা পুরসভাকে দীর্ঘদিন বলেও নিকাশি ব্যবস্থার সুরাহা করেনি। এ ভাবে কতদিন জলবন্দি হয়ে থাকতে হবে জানি না।” ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাজারপাড়া, মুসলিমপাড়াও একই অবস্থা। এখানকার বাসিন্দা শেখ জুলফিকার বলেন, “আমরা পুরসভার পরিষেবা থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত।”
পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সাবিরুদ্দিন মোল্লাও এ বারে বিভিন্ন ওয়ার্ড জলমগ্ন হওয়ার পিছনে পুরসভার বিরুদ্ধে উন্নয়নে উদাসীনতা এবং টাকা তছরুপের অভিযোগই তুলেছেন। ভাইস-চেয়ারম্যান তৃণমূলের নাজিমা খান এই অভিযোগ মানেননি। তিনি বলেন, “প্রবল বৃষ্টির ফলেই এই অবস্থা। আমরা যুদ্ধকালীন তত্পরতায় কাজে নেমেছি। বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছি। পুরসভার থেকে আমরা ত্রিপল পাঠাচ্ছি এবং দ্রুত নিকাশির ব্যবস্থা করছি।” |