বলিউডের ছবিতে মেয়েরা ক্রমশ সম্পর্কের শুদ্ধতা, যৌনতার সংস্কার থেকে
বেরিয়ে আসছিল। নিজের শর্তে, পুরুষ-নির্ভরতার প্রয়োজন ছাড়াই।
অতএব পুরুষতন্ত্রের অস্বস্তির শুরু। অতএব প্রত্যাঘাত। |
দীপিকা দৌড়চ্ছেন, চলন্ত ট্রেনের পাশে পাশে, ট্রেনের কামরা থেকে হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে রয়েছেন রণবীর... ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি (২০১৩) দেখতে দেখতে প্রায় দু’দশক আগের দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে (১৯৯৫) মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেখানেও শাহরুখ দু’দু’বার কাজলকে চলন্ত ট্রেনে তুলে নেন, প্রথম বার ইউরোপ-ভ্রমণেই প্রেম, পরের বারও পশ্চিম ইউরোপে যাত্রা, বিয়ের জন্যে। কাজলের মতো দীপিকারও পড়াশোনা-অভিভাবকের ঘেরাটোপ ছেড়ে রণবীরের সঙ্গে ওটাই প্রথম পর্বতারোহণ ও প্রেম। কোনও মেয়ের জীবনে এই যে জীবন-বদলে-দেওয়া অভিজ্ঞতা, তা অমোঘ নিয়মে ঘটে কোনও পুরুষের হাত ধরে। শাহরুখ থেকে রণবীর, বলিউডের নায়ক যেন রামচন্দ্র আর নায়িকা অহল্যা। সেই পুরাণকথা সমানে চলছে।
তবে নতুন মোড়কে। মোড়কটা বদলেছিল নব্বইয়ের দশকে। এই সেই সময়, যখন ‘উদার’ অর্থনীতির হাত ধরে বলিউড ‘গ্লোবাল’ হয়ে উঠল। শাহরুখের দিলওয়ালে’র মতো ছবির রোমান্সে এল বিশ্বায়নের বাতাস। কিন্তু সেই গ্লোবাল-এর ভিতরেই নিহিত হল লোকাল। ইন্ডিয়ার ভিতরে যেমন থাকে ভারত। বলিউডের বিদেশ হয়ে উঠল ভারতীয় জীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। দিলওয়ালে’তে যেমন ভাগাভাগি করে থাকে পশ্চিম ইউরোপ আর ভারত। পঞ্জাবের সরষে ফুলের খেত, দোপাট্টা, দেশীয় নারী, বিশাল পরিবার, দেশজ রীতিনীতি-আচারব্যবহার; লন্ডনে সে সবেরই আবার এক ‘নিউক্লিয়াস’ রূপ, লন্ডন যেন পঞ্জাবেরই সম্প্রসারিত ‘হোমল্যান্ড’। লন্ডনে বেড়ে-ওঠা শাহরুখ পঞ্জাবে এসে কাজলের পরিবারের সঙ্গে এমন মিলেমিশে যান যে তাঁকে ঐতিহ্যের সংস্কারে লালিত ভারতীয় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না, এমনকী ইউরোপ ভ্রমণ পর্বেও প্রেমের সুযোগে কাজলের সঙ্গে বিবাহ-পূর্ব সহবাস করেন না তিনি, ভারতীয় নারীর সম্মান রক্ষার্থে। ইউরোপের আধুনিক মাটিতেই সনাতন ভারতকে সাজিয়ে তোলা, পুরুষের নিয়মে, পুরুষতন্ত্রের নিয়মে। সে পুরুষ আধুনিক হতে পারে, পছন্দের নারীকে সে আধুনিক করে তুলতে পারে, কিন্তু লাগাম তারই হাতে। |
পরদেশ, হম দিল দে চুকে সনম, কহো না প্যার হ্যায়, কভি খুশি কভি গম, চিনি কম... প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে তাল-মেলানো আধুনিক পুরুষেরাই যেন নির্ভরযোগ্য পরদেশি হিরো, আধুনিকতার ব্যবহারে যাতে পিছিয়ে না পড়ে মেয়েরা, সে দায়িত্ব তারা কাঁধে তুলে নেয়। ঠিক যেমন উনিশ শতকে পশ্চিমী শিক্ষায় নব্য-শিক্ষিত আধুনিক বঙ্গসন্তান তার সঙ্গিনীকে মনের মতো করে গড়ে তুলত। আমেরিকা-ইউরোপের আলো-হাওয়ায় স্নাত এ কালের এই নতুন পৌরুষও ভালবাসার প্রশ্নে মেয়েদের সরব করে তোলে, প্রেমকে কী ভাবে নিজেদের জীবনে ঠাঁই দেবে মেয়েরা, তা-ও ঠিক করে দেয়। ভুবনায়নের ভারপ্রাপ্ত এই নতুন ভারতীয় পুরুষদের হাত ধরে যে আধুনিকতায় পৌঁছয় মেয়েরা, তা আসলে পুরুষেরই উপযুক্ত হয়ে ওঠা, বিবাহের মতো সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিকতা, পরিবারপ্রথা, মায় মাতৃত্বেই থিতু হতে হয় তাদের। ভিন্নমার্গী মীরা নায়ারও নতুন শতকের শুরুতে স্বঘোষিত ‘বলিউড মুভি’ মনসুন ওয়েডিং-এর প্রচারপত্রে মঙ্গলচিহ্নের ওপর হিন্দি হরফে লেখেন: ‘শাদি মে জরুর আনা’!
দেশের বাইরে আর একটা দেশ বানিয়ে, মেয়েদের পরম পুরুষনির্ভর করে যখন নিশ্চিন্ত হতে চাইছে বলিউড, অস্বস্তির শুরু তখনই। দেখা গেল, বলিউডি রোমান্সের পূর্বনির্দিষ্ট পরিণতি আমূল পাল্টে না গেলেও সময়ের ঝাঁকুনিতে প্রায়ই পুরনো ‘ফ্রেম’ ছেড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ফাঁকফোকরে ক্রমাগত ‘স্পেস’ তৈরি হচ্ছে। একুশ শতক যত গড়াচ্ছে, বিদেশের অনুষঙ্গে বোনা ছবিগুলোতে সম্পর্কের একটেরে শুদ্ধতা, যৌনতার সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসছে মেয়েরা। কাঙ্ক্ষিত নায়িকাকে গ্রহণের সময় পুরুষটিও তাকে তার পুরনো সম্পর্কসহই স্বীকার করে নিচ্ছে। নায়করাও সরে আসছে তাদের একবগ্গা পৌরুষ থেকে। দিল চাহতা হ্যায়, কাল হো না হো, সালাম নমস্তে, হম তুম, নীল-এন-নিকি, কভি আলবিদা না কহেনা, নমস্তে লন্ডন, লাভ আজকল, ককটেল, যব তক হ্যায় জান... এমনকী জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা বা এক ম্যায় অওর এক তু’র মতো ছবিতে বিকল্প রোমান্সের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া গেল, যা বিয়ে বা পারিবারিক প্রথাকে প্রায় অস্বীকার করে, মেয়েরা নিজেদের শর্তে বাইরে আসে, পুরুষ-নির্ভরতার তেমন প্রয়োজন হয় না আর।
এমতাবস্থায় ইয়ে জওয়ানি...’র দীপিকা ওরফে নয়না তলওয়ার-এর মতো দেশীয় শিকড়ে বিশ্বাসী একটি চরিত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বলিউডে। বোহেমিয়ানার সঙ্গে কর্তব্যবোধ, বিধিনিষেধ না মানার সঙ্গে নীতিবোধ দুই-ই বজায় রাখতে পারার আশ্চর্য ভারসাম্য চরিত্রটিতে। সে চাঁদনি রাতে একা কোনও পুরুষের সঙ্গে বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়ায় ওঠে; সে-ই আবার পড়াশোনায় ‘ফার্স্ট’ হয়, ‘মেডিসিন’ পড়ে, ‘ক্লিনিক’ চালায়, বাবা-মায়ের দেখভাল করে। যে পুরুষের হাতযশে সে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, সেই রণবীরই বিদেশমুখো হলে সে আর পুরুষটির উপর নির্ভরতা আঁকড়ে বাঁচে না, স্বনির্ভর হয়ে ওঠে।
ফলে আমেরিকায় পাড়ি-জমানো রণবীর, যিনি সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াতে চান; যিনি একমুখী দাম্পত্যে বিশ্বাসী নন বলে বিয়েতে অবিশ্বাসী, মেয়েদের সঙ্গে একাধিক সম্পর্কে, এমনকী শুধু শারীরিক সম্পর্কেও আগ্রহী; তিনিও দীপিকার প্রেমে পড়ে যান।
আর তখন রণবীরকে তাঁর পুরনো সম্পর্কসহই গ্রহণ করেন দীপিকা, নিজে কিন্তু রণবীর ছাড়া অন্য কোনও পুরুষে গমন করেন না, ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুশাসন মেনে চলেন। দীপিকা ফের বলিউডি রোমান্সকে বিয়ে-পরিবার-মাতৃত্বের চেনা ছকে ফিরিয়ে আনেন। বিয়েতে রাজি হওয়ার আগে-পরে নিজেই শর্ত দেন দীর্ঘ একঘেয়ে হলেও দাম্পত্য মধুর, তা ভাঙা চলবে না। বিদেশে বছরে বার দু’য়েক যেতে পারেন রণবীর, কিন্তু আর কোনও সম্পর্কে জড়ালে চলবে না। দীপিকা এ দেশেই থাকবেন, মাটন বিরিয়ানি আর গাজরের হালুয়া খাবেন, উদয়পুরের সূর্যাস্ত আর মুম্বইয়ের বর্ষা দেখবেন, ধোনির ছক্কায় ভারতীয় ক্রিকেট টিমের জয় দেখবেন, সর্বোপরি ছ’টা বাচ্চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে হ্যারি পটার-এর ফিল্ম দেখবেন। বলতে গেলে রণবীরের ‘বদ্তমিজ দিল’কে নিজের আঁচলে বেঁধে ফেলেন তাঁর ‘দিলওয়ালি গার্লফ্রেন্ড’। দীপিকার অন্দর বা ঐতিহ্য রণবীরের বাহির বা আধুনিকতাকে আত্মসাৎ করে নেয়। ‘ইন্ডিয়ান’ নয়না তলওয়ার, ‘গ্লোবাল’ বলিউডের ভারতীয় ভিতটাকে আরও মজবুত করে দিল। |