হিন্দি ফিল্মের কল্যাণে হাজি মস্তান নামটি ছাপোষা ভারতবাসীর বিলক্ষণ চেনা। ষাটের দশকের বম্বে শহর নাকি তিনি সহ-খলনায়কদের সহিত ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন নিজের জন্য রাখিয়াছিলেন কেবলমাত্র সমুদ্র। উদারতা নহে, কাণ্ডজ্ঞান। কারণ, সেই সমুদ্রপথেই পশ্চিম এশিয়া হইতে চোরাই সোনা পৌঁছাইত বম্বের উপকূলে। ‘রাগী যুবক’ অমিতাভ বচ্চনের অভিনীত চরিত্রগুলির সহিত সামান্য পরিচয় থাকিলেই দৃশ্যটি মনে পড়িয়া যাইবে অন্ধকার সমুদ্রতটে ভেরা নৌকা হইতে বাক্সের পর বাক্স সোনার বাঁট গাড়িতে উঠিতেছে। ‘স্মাগলিং’ নামক পেশাটি, বাস্তবেই হউক বা চলচ্চিত্রে, রীতিমত লাভজনক ছিল। পুলিশ এই চোরাচালান ঠেকাইতে পারে নাই। মনমোহন সিংহ পারিয়াছিলেন। কারণ, মনমোহন সিংহ চোরাচালানের অর্থনৈতিক ভিত্তিটি ভাঙিয়া দিতে পারিয়াছিলেন। চোরাচালানের রমরমা ছিল, কারণ বিদেশ হইতে সোনা (এবং আরও অনেক জিনিস, যেমন ইলেকট্রনিক পণ্য, বিদেশি মদ) আমদানি করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু, ইন্দিরা গাঁধীর দরজা আঁটা অর্থনীতির দায় বহন করিবার বাসনা দেশবাসীর ছিল না। ফলে, দেশের বাজারে চাহিদা ছিলই। আইনি পথে সেই সোনা জোগাড় করিবার উপায় ছিল না, ফলে হাজি মস্তানরা চোরাপথে সেই সোনা বাজারে আনিতেন। তাহাতে দেশের ক্ষতি হইত প্রাপ্য রাজস্ব হইতে বঞ্চিত হইতে হইত। লাভ হইত চোরা কারবারিদের। অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সোনা আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ তুলিয়া দেন। সোনার কালোবাজার ভাঙিয়া পড়ে। যাহা বাজারে চাহিলেই মেলে, তাহার জন্য কেহ চোরাপথে হাঁটিবে কেন? চাহিদা ও জোগানের সরকার-সৃষ্ট অসামঞ্জস্যই কালোবাজারের আর্থিক ভিত্তি। ঘরের কাছেই আর একটি উদাহরণ আছে। বস্তুত, ছিল। এক কালে চলচ্চিত্রের টিকিটের দাম কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। সব ছবির চাহিদা সমান হয় না। যেমন, অমিতাভ বচ্চন যে সব ছবিতে স্মাগলার-এর ভূমিকায় অভিনয় করিতেন, তাহার চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। মানুষ কিছু বেশি দামেও ছবি দেখিতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু সেই দামে টিকিট বেচিবার উপায় হল-মালিকের ছিল না। ফলে, প্রেক্ষাগৃহের সম্মুখে ‘ব্ল্যাকার’-দের উপস্থিতি ছিল অনিবার্য, যাহারা মানুষের বাড়তি দাম দেওয়ার ইচ্ছার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিত। এখন তাহারা কার্যত বিলুপ্ত সিনেমার চাহিদা বুঝিয়া প্রেক্ষাগৃহই টিকিটের দাম বাড়ায়-কমায়। বাজারকে অস্বীকার করিবার ফল প্রায় সর্বদাই মারাত্মক এই কথাটি মনমোহন সিংহ বিস্মৃত হইয়াছেন, বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সোনা আমদানির পরিমাণ কমাইতে পর পর যে সিদ্ধান্তগুলি সরকার করিল, তাহাতে ফের সত্তরের দশক ফিরিয়া আসিবে না কি? দশ শতাংশ আমদানি শুল্ক, আমদানির একটি অংশ রফতানির জন্য নির্দিষ্ট করিয়া রাখা, খুচরা বিক্রয়ে বিবিধ বাধানিষেধ সব পথই প্রাক-সংস্কার আমলের দিকে ধাবিত হইতেছে। সরকার চাহিলেই বাজারের চাহিদা কমিবে না। আশঙ্কা প্রবল, সাদা পথে না পারিলে মানুষ ফের কালো পথে সোনা কিনিবে। ২০১৩ সালের এপ্রিল হইতে জুলাই, এই চার মাসেই যত চোরাই সোনা ধরা পড়িয়াছে, তাহার পরিমাণ গত দুই অর্থবর্ষের মোট বাজেয়াপ্ত সোনার তুলনায় বেশি। অর্থাৎ, সোনার চোরাচালান ফের বাড়িতেছে। বাইশ বৎসর পর। হাজি মস্তান কি তবে একুশ শতকে পুনরাগমনায় চ? |