নিম্নচাপের বৃষ্টির সঙ্গে জোট বাঁধল পূর্ণিমার ভরা কোটাল। তাই জোয়ারের জল ঢুকে পড়া আটকাতে ঠিকমতো খোলা গেল না লকগেট। ফলে নিকাশির ব্যবস্থা যতই থাক, তা পুরোপুরি কাজে এল না। সব মিলিয়ে কলকাতার জল বিকেলে কিছুটা নামলেও সন্ধের ভারী বৃষ্টি ফের শহরকে ডোবাল।
তবু নিচু এলাকা বলে চিহ্নিত পুরনো কলকাতার যে অংশে সামান্য বৃষ্টিতেও জল উপচে উঠতে দেখা যায়, মঙ্গলবার দুপুরেও সে-সব অঞ্চলে খুব একটা জল দাঁড়াতে দেখা যায়নি। আমহার্স্ট স্ট্রিট-ঠনঠনিয়ায় নৌকো চলার চেনা দৃশ্য অবশ্য বিকেলেও দেখা যায়নি।
কিন্তু পুরসভার পাম্পগুলি নাগাড়ে কাজ করেও সন্ধের বৃষ্টি হানা সামাল দিতে না পারায় রাত বাড়লে শহরের বেশ কয়েকটি রাজপথ জলমগ্ন হয়ে পড়ে। আটটা বাজতে না-বাজতেই শহরের বাস-অটো চলাচল কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় মেট্রোয় ভিড় উপচে পড়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। ইলেকট্রিক মিটার জলে ডুবে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সিইএসসি-র তরফে সতর্কতার বার্তা দেওয়া হয়। |
যথারীতি ভেসেছে উত্তর কলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রিট। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক |
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “বিকেলের দিকে পরিস্থিতি অনেকটা সামলে নিলেও সন্ধের বৃষ্টিতে ফের সমস্যা হল। একনাগাড়ে চেষ্টা চালিয়ে পরিস্থিতি সামলানো হচ্ছে।” ই এম বাইপাস লাগোয়া এলাকার দুর্গতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিকাশি দফতরের এক আধিকারিক। তাঁর কথায়, “১০৬, ১০৭, ১০৮ এবং ১০৯ ওয়ার্ডের নিকাশি ব্যবস্থা লাগোয়া খালের উপরে নির্ভরশীল। কী করে জল বেরোবে? জোয়ারের কারণে ওই খালেই তো জলস্তর ফুলেফেঁপে উঠেছে।” সোমবার রাত থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। নিকাশি দফতরের এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, “ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শহরে ঘণ্টায় ছ’মিমির বেশি বৃষ্টি পড়লেই জল জমবে।” তিনি জানান, ৪৮ ঘণ্টা ধরে যা বৃষ্টি হয়েছে, লকগেট খোলা থাকলে তা বার করতে সুবিধা হত। কিন্তু জোয়ারের কারণে লকগেট বন্ধ রাখা হয়। যেখানে পাম্পের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখান থেকে কিছু পরিমাণ জল বার করা সম্ভব হয়েছে।
তার আগে কলকাতার ‘রেনি-ডে’-র মেজাজটাও জলস্তরের সঙ্গেই তাল মিলিয়েই ওঠা-নামা করেছে। দুপুরের টিফিনটাইমে মহাকরণের ক্যান্টিন খিচুড়ি-উৎসবে মেতেছিল। সেই মেজাজটা স্থায়ী হয়নি। বেহালায় বিদ্যাসাগর হাসপাতালের কাছে দ্বারিক মুখার্জি রোডে হাঁটুর উপরে জল উঠে যায়। এ নিয়ে পুরসভায় বারবার অভিযোগও এসেছে। মেয়রের ব্যাখ্যা, কেআইপি-র কাজ চলছে বলে এই সমস্যা হয়েছে।
পাশাপাশি, উত্তর শহরতলির মধ্যমগ্রাম, সোদপুরে কোমরসমান জল ঠেলে রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেও অনেকেই মুশকিলে পড়েছেন। পানিহাটির সরকারি হাসপাতাল ও কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতাল চত্বর জলমগ্ন হয়ে পড়ে। পানিহাটি হাসপাতালের আউটডোরেও জল ঢুকেছে।
কলকাতার উপকণ্ঠে মহেশতলায় একটি কালভার্ট ভেঙে পড়ায় জলবন্দি মানুষের তোপের মুখে পড়তে হয় প্রশাসনকে। দুপুর থেকে কয়েক ঘণ্টা বজবজ ট্রাঙ্ক রোড অবরোধ করেন সারেঙ্গাবাদ-সাঁতরাপাড়ার বাসিন্দারা। সামাল দিতে হাজির হয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশকর্মীরা। জনতার ফতোয়া, পুলিশ নিজেরা জল ঠেলে না-হাঁটলে অবরোধ উঠবে না।
পরিস্থিতি সামলাতে অগত্যা পুলিশকর্মীদের জুতো হাতে জল মাড়াতে হয়। বারুইপুর পুর-এলাকায় গাড়িতে জল দেখতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক তথা বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান মুখোপাধ্যায়ও।
১১ নম্বর ওয়ার্ডের গোলপুকুর, মণ্ডলপাড়ায় বাড়ির ভিতরেও জল ঢুকে গিয়েছে বলে খবর। ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাওয়ার উপক্রম ঘটলে বিধায়কের গাড়িও খুব একটা ভিতরে ঢুকতে পারেনি।
দিনের বেলায় বাড়তি বৃষ্টি পেয়ে বেশি ভুগেছে দক্ষিণ কলকাতাই। আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকের অফিস, কলকাতা পুলিশের বডিগার্ড লাইন্স পুকুরের চেহারা নিয়েছিল। সব থেকে খারাপ অবস্থা হয় ই এম বাইপাস-সহ বেহালা, গড়িয়া, যাদবপুর, বাঁশদ্রোণী এবং গার্ডেনরিচের। বন্ডেল গেটের ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডও একটানা জলবন্দি হয়ে থাকে। দক্ষিণ কলকাতার ন’টি জায়গায় গাছ ভেঙে থমকে যায় যানচলাচল। এ ছাড়া বৃষ্টির চাপে শহরে তিনটি পুরনো বাড়িও ভেঙে পড়েছে।
নিকাশি দফতরের স্পেশাল অফিসার অমিত রায় জানান, বৃষ্টির ফলে শহরে যে জল জমে তা মূলত হুগলি ও কুলটি নদীতে গিয়ে পড়ে। এ দিন জোয়ার থাকায় ওই দুই নদী দিয়ে জল বেরোতে পারেনি। দক্ষিণ কলকাতার এলাকাগুলোর নিকাশি যে খালের উপর নির্ভরশীল, সেই টালি নালা বা চড়িয়াল খালের জলস্তর নদীর জোয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। ফলে খালের জল বেরোতে পারেনি। কলকাতাকে এটাই ডুবিয়েছে বলে মনে করছেন ওই অফিসার।
পুরসভা সূত্রের খবর, গত অমাবস্যার ভরা কোটালে যে পরিমাণ জল নদী বেয়ে শহরে ঢুকেছিল, এ বার তার পরিমাণ প্রায় চার ফুট বেশি। ফলে সমস্যা ঘোরতর হয়েছে। এর ফলেই অনেক জায়গায় পাম্পের সাহায্যেও জল বার করা যায়নি। এ সব কারণেই পুর-তৎপরতা সত্ত্বেও মানুষকে ভুগতে হয়েছে।
|